ক্ষুধার্ত মানুষের একটাই কবিতা, খাবার। এ-কথা বলেছিলেন যে গান্ধী তাঁকে অস্বীকার কী করে করবে দেশ! সংকীর্ণ রাজনীতির গণ্ডিতে তাঁকে বেঁধে ফেললে ক্ষতি আদতে আমাদেরই। লিখছেন সরোজ দরবার।
আর্তের যন্ত্রণা তো কবিরের গান দিয়ে মুছে দেওয়া যায় না। তা অসম্ভব। রবি ঠাকুরকে লেখা তাঁর সেই বিখ্যাত চিঠিতে অনাহারক্লিষ্ট, শক্তিহীন এক ভারতবর্ষের কথা বারবার তুলে ধরতে চাইছিলেন যে-মানুষটা, তাঁর বিরুদ্ধে তখনই অনেক অভিযোগ। মহাত্মা গান্ধী। একদিকে তাঁর নামেই জেগে ওঠে গণমানুষের অন্তরে আন্দোলন। আবার সেই তিনি স্বরাজ প্রতিষ্ঠার জন্য যে-পথ বেছে নিচ্ছেন, আন্দোলনের বিভিন্ন মুহূর্তে যে-সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তা অনেক সময় অবাক করছে দেশের তাবড় চিন্তাবিদদের। এমনকী রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তার ব্যতিক্রম নন। গান্ধীর সঙ্গে তাঁর দর্শনগত ভিন্নতা বারেবারেই দুজনকে মতান্তরের প্রান্তে এনেছে। মনান্তর এখানে অপ্রাসঙ্গিক, কেননা দুই মহৎ এবং বৃহৎ মানুষ বহু আগেই সেই সংকীর্ণতা অতিক্রম করে গিয়েছিলেন। তবু দর্শনের বিপরীত অবস্থানই দুজনকে যেন একটা কথোপকথনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ যেন গান্ধীর থেকে অনেক বেশি স্পষ্টতা দাবি করেন। তাঁর কর্মপন্থা নিয়ে প্রত্যাশা করেন আরও একটু বেশি স্বচ্ছতা। আর তার উত্তর দিতে গিয়েই গান্ধী যেন খানিক আবেগেই বলে চলেন, সকালের নতুন আলোয় পাখিরা গান গায়। গাইতে পারে, কেননা তারা তো দিনের খাদ্যটুকু পেয়েছে। ডানায় পেয়েছে বল। আর গান্ধী দেখছেন ভারত-আকাশের ক্লান্ত ডানা মুড়ে বসে থাকা মানুষ-পাখিগুলোকে। শক্তিহীন, বলহীন, তাদের ডানায় যেন এতটুকু উড়ান আর অবশিষ্ট নেই। বারবার ডানা ঝাপটিয়েও তারা তাই আর উড়তে পারছে না। অতএব দরকার খাবার। ক্ষুধার্ত মানুষ চায় একটাই কবিতা, তা হল খাবার। আর সে-খাবার কেউ তাকে হাতে তুলে দেবে না, তাকে তা অর্জন করে নিতে হবে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়ে এসেও আমরা উপলব্ধি করতে পারি, গান্ধীর এই অনুভব কী অমোঘ, কতখানি অনিবার্য। এই গান্ধী আমাদের কাছে অনস্বীকার্যই।
আরও শুনুন: গীতা ছিল প্রিয় গ্রন্থ, মহাত্মার কাছে যে শ্লোকগুলি হয়ে উঠেছিল মহামন্ত্র
এ-কথা ঠিক যে, তাঁর দর্শন সরল নয়। যে মানুষটা সারকথা তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘আমার জীবনই আমার বাণী’- তাঁকে অনুধাবন করতে হবে তাঁর জীবনের বহুমাত্রিকতাতেই। বোধহয় এই বহুমাত্রিকতার উপলব্ধিই তাঁর জীবনের সবথেকে বড় বাণী। এই বাণীই সমস্ত অন্তঃকরণ দিয়ে শুনতে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অনুভব করতে বলেছিলেন, ‘কী প্রচণ্ড তাঁর সংকল্পের জোর’। এই ‘সংকল্প’ শব্দটি ধরে যেন আমরা গান্ধীর কাছে পৌঁছনোর একটা রাস্তা খুঁজে পেতে পারি। আমরা সকলেই জানি, সত্য ও অহিংসাকে তিনি স্থান দিয়েছিলেন সর্বাগ্রে। এই সত্য, যার উদ্ভব ‘সৎ’ থেকে, তা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। গান্ধীর এই সত্যের ধারণা যেন উপনিষদীয় পরমের ধারণার সঙ্গে লীন হয়ে যায়। স্বার্থহীন এই সত্য অনুশীলনের মধ্যে আত্মনিগ্রহ আছে। আবার সেই পথেই আছে ঈশ্বরের সন্ধানও। ফলত, শুধু সত্য কথা বলা বা সত্য পথে চলা নয়, আমরা উপলব্ধি করতে পারি গান্ধীর এই ‘সত্য’ এক রকমের আধ্যাত্মিক বোধ। গান্ধী সেই বোধেরই জাগরণ চাইছিলেন। আর সেখানে পৌঁছতে গেলে অহিংসা অনুশীলন করাই পথ। সত্যের বাস নিজের ভিতরে। তাই হিংসার পথ ধরলে মানুষ নিজের আত্ম তথা অন্তঃস্থ সত্য থেকেই দূরে সরে যান। এই অনুভবের পথই আসলে গিয়ে মিশে যায় প্রেমে। গান্ধী তাঁর চেতনা থেকে এবং কর্মপদ্ধতি থেকে ধর্মকে বাদ দিয়ে দেননি। তিনি বিশ্বাসই করেননি যে ধর্মকে বাদ দিয়ে কোনও কাজ করা সম্ভব। সমাজতন্ত্রের রূপ সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনা ছিল, তার একরকম আদলও তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। তবে তা ধর্ম বাদ দিয়ে নয়। আবার হিন্দু ধর্মের প্রতি নিষ্ঠ থাকলেও, এই ধর্মের বহু গোঁড়ামিকেও তিনি স্বীকার করেননি। বরং সে সবের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন। সঙ্গত প্রশ্ন ওঠে, হিন্দু ধর্ম ব্যতীত অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি কি গান্ধী বিমুখ ছিলেন? বিশেষত মুসলমানদের প্রতি! গান্ধীর দর্শনে সত্য আর অহিংসার ভিত্তি ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলে, এর উত্তর স্পষ্ট হয়ে যায়। গান্ধী চেয়েছিলেন সেই বোধের জাগরণ, যার দরুন সম্প্রীতি আপনা থেকেই ঘনিয়ে উঠবে। তা বাইরের চাপিয়ে দেওয়া জিনিস হয়ে উঠবে না, হবে অন্তরের জিনিস। বরং গান্ধীর অহিংসা নীতিই বলে, সংখ্যালঘুর অধিকার যাতে সামান্য ক্ষুণ্ণ না হয়, সেদিকে নজর রাখতে। অর্থাৎ গান্ধীর দর্শনের যে অভিমুখ তা মানুষের আত্মিক উন্নতির একটা সোপান। যদি পরার্থে জীবনকে উৎসর্গ করার মতো নৈতিক আধার পাওয়া যায়, আর তা যদি অনুশীলনের মাধ্যমে সম্ভব হয়ে ওঠে, তবে আদর্শ এক সমাজ গঠিত হবে। সেই সমাজ স্বাধীনতা অর্জনও করে নিতে পারবে, বরং তা নিজের ভিতর থেকে শক্তিশালী ও স্বাধীন হয়ে উঠবে। গান্ধীর জীবন এবং তাঁর অজস্র লেখালিখির ভিতর এই বার্তা নিহিত।
আরও শুনুন: ‘বাপু’ না থাকলে অচল টাকা! কেন ভারতীয় নোটে মহাত্মা গান্ধীর ছবি থাকে জানেন?
আবার তাঁকে নিয়ে সমালোচনারও অবকাশ রয়েছে বহু। আত্মিক উন্নতির জন্য গান্ধী কথা বলছেন বটে, তবে তাঁকে পালন করতে হচ্ছে একজন জনগণমন অধিনায়কের দায়। ফলত, তাঁর সব সিদ্ধান্ত যে প্রশ্নাতীত তা একেবারেই বলা যায় না। বরং, তুঙ্গ মুহূর্তে ওঠা আন্দোলন থামিয়ে দেওয়ায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ারই জন্ম দিয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন ঘটনায় তাঁর নিশ্চুপ থাকা সংশয় বাড়িয়েছে। নানা সময়ে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কিত চিহ্নগুলি তুলে ধরতে ধরতে তিনি যে অসন্তোষের বীজ রোপণ করেছিলেন, তাই-ই যে ক্রমে সাম্প্রদায়িক ডালপালা মেলেছে তা ইতিহাসের অগোচর নয়। হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের জন্য তাঁর চেষ্টা আর সাম্প্রদায়িকতা জাগিয়ে তোলার এই অভিযোগ- দুই-ই আজ পাশাপাশি রেখে কাটাছেঁড়া প্রয়োজন। পাশ্চাত্যের প্রশ্নে বা বর্ণাশ্রম নিয়ে তাঁর যা মত, সে মতের সারবত্তাও আজ খতিয়ে দেখা জরুরি। কেননা মনে রাখা ভাল, গান্ধী একমাত্রিক নন। অভ্রান্তও নন। অবতারও নন। মার্কসবাদের মতো করেই বলা যায়, গান্ধী নিজেও কোনও প্রণালী নন, পন্থাই। সেই পথটুকুর মধ্যে নানা মত আছে। কখনও তা বেশ অস্পষ্টতারই জন্ম দেয়। কখনও হয়ে ওঠে স্ববিরোধী স্বরের সম্মেলন। আর তাই তাঁকে নিয়ে রাজনীতিও হয় বেশি। বেছে বেছে কোনও এক রকমের গান্ধীকে তুলে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলি যে যার উদ্দেশ্য পূরণ করে। তবে, গান্ধীকে অনুধাবন সম্ভব এই রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডায় নয়। তাঁকে নিয়ে আলোচনা, এমনকী কঠোর সমালোচনাতেই। সেই সমালোচনার ভিতর দিয়ে আমরা গান্ধীকে অন্যভাবে উদ্ভাষিত হতে দেখব। দেখব, আর্তের জন্য, অনাহারক্লিষ্ট দেশবাসীর জন্য, ক্লান্ত-ডানা নিয়ে বসে থাকা মানুষপাখির জন্য মানুষটার হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ তা মিথ্যে নয়। কিন্তু যে পথ ধরে তিনি হেঁটে গিয়েছেন তা অগণিত প্রশ্নে মুখর। যেন নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করতে করতে, নিজেকেই নিজে খণ্ডন করতে করতে তিনি এগিয়েছেন। অতএব সেই প্রশ্নগুলির উত্তর তাঁর জীবনের ভিতরই আছে, আছে তাঁর লেখাপত্রে। গ্রহণ-বর্জন তো সময়ের নিজস্ব অধিকার।
আর যদি গান্ধীকে অস্বীকারের পথে হাঁটে এ-দেশ? একদিকে তাঁকে ফুলমালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো, অন্যদিকে তাঁর দর্শনকে মুছে দেওয়া, এই যদি চলতে থাকে! তবে বুঝতে হবে, বহুমাত্রিক এক জীবন এবং দর্শনকে স্বীকার করে নেওয়ার মত মননের গভীরতা আজ আর আমাদের অবশিষ্ট নেই। তাই ছোট রাজনীতির সংকীর্ণতায় আমরা বেঁধে ফেলতে চাই স্বয়ং গান্ধীকেও। নিজস্ব ভাবনার মাপে, রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির মাপে প্রেক্ষিতহীন উদ্ধৃতির মতো যদি গান্ধীকে ব্যবহার করা হয়, তবে তা তাঁকে অস্বীকার করাই হয়। সে অস্বীকারে গান্ধীর ক্ষতিবৃদ্ধি বিশেষ কিছু নেই, লোকসান আদতে সমকালীন ভারতবর্ষেরই।