ধরনা দেওয়া- অধিকার বুঝে নেওয়ার আন্দোলনে প্রাচীন এক পদ্ধতি। বর্তমানে এর গ্রহণযোগ্যতা খানিকটা কমলেও, একেবারে উবে যায়নি। বরং গুরুতর বিষয়ের পাশাপাশি, ছোটখাটো বিষয়েও আজকাল ধরনা দিতে দেখা যায়। তবে আন্দোলনের এই পদ্ধতির উৎস কি রামায়ণে? রামায়ণের কাহিনিতেই আছে সেই ইঙ্গিত। আসুন শুনে নেওয়া যাক।
অধিকার বুঝে নেওয়ার প্রখর দাবিতে আন্দোলনের পথে নেমে ধরনা দিতে বসা। শুধু ভারতবর্ষে নয়, সারা বিশ্বই এই ধরনের আন্দোলন পদ্ধতির সাক্ষ্য দেয়। বিশেষত শ্রমিক আন্দোলনগুলির দিকে তাকালে ধরনা দেওয়ার অজস্র নমুনা মেলে। এবং সেই পদ্ধতিতে কাজও হয়েছে। শ্রমিকের দাবির কাছে মাথা নুইয়েছে মালিক শ্রেণি। বর্তমান বিশ্বে অবশ্য দাবি আদায়ের এই স্বীকৃত পদ্ধতিতে অনেক বদল এসেছে। কেননা শ্রম ও শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনের সম্পর্কের অনেকটাই বদল হয়েছে। কিন্তু সে প্রসঙ্গ আলাদা। আমাদের বলার কথা এই যে, দাবি আদায়ে ধরনায় বসার রীতিটি বেশ প্রাচীন। এবং এর চিহ্ন মিলছে আমাদের রামায়ণেই।
আরও পড়ুন: Ramayana: রামায়ণের আদিতে ছিলই না লক্ষ্মণরেখা! কোথা থেকে এল এই গল্প?
আসলে রামায়ণ বা মহাভারত তো আমাদের ইতিহাসই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাটি এই প্রসঙ্গে আর একবার মনে করা যাক,- “রামায়ণ-মহাভারতকে কেবলমাত্র মহাকাব্য বলিলে চলিবে না, তাহা ইতিহাসও বটে: ঘটনাবলির ইতিহাস নহে, কারণ সেরূপ ইতিহাস সময়বিশেষকে অবলম্বন করিয়া থাকে– রামায়ণ-মহাভারত ভারতবর্ষের চিরকালের ইতহাস। অন্য ইতিহাস কালে কালে কতই পরিবর্তত হইল, কিন্তু এ ইতিহাসের পরিবর্তন হয় নাই। ভারতবর্ষের যাহা সাধনা, যাহা আরাধনা, যাহা সংকল্প তাহারই ইতহাস এই দুই বিপুল কাব্যকর্মের মধ্যে চিরকালের সিংহাসনে বিরাজমান।” সুতরাং এই ইতিহাসের মধ্যেই আছে ধরনার আদি চিহ্ন।
এই ধরনার খোঁজে আমাদের পৌঁছে যেতে হবে রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে। পিতৃসত্য পালনের জন্য রাম ততক্ষণে রাজ্য ত্যাগ করে বনের দিকে এগিয়ে গিয়েছেন। সঙ্গে আছেন সীতা এবং লক্ষ্মণ। ইতিমধ্যে রাজা দশরথের মৃত্যু হয়েছে। ভরতও ফিরে এসে সব শুনেছেন। এবং সব শুনে তিনি তো যারপরনাই রেগে গিয়েছেন। বুঝেছেন, রামকে বনবাসে পাঠানোর মাধ্যমে একটি অধর্ম হয়ে গিয়েছে, যার প্রতিকার প্রয়োজন। অতএব তিনিও বনে চললেন, রামকে ফিরিয়ে আনার জন্য। এই পরিসরেই হচ্ছে রাম ও ভরতের মিলন। প্রাথমিক কথাবার্তার পরই, ভরত জানালেন যে, তিনি রাজ্যভার গ্রহণে ইচ্ছুক নন। রাম যেন ফিরে গিয়ে রাজ্যভার গ্রহণ করেন। কেননা, জ্যেষ্ঠ বর্তমান থাকতে কনিষ্ঠের রাজভার গ্রহণ কখনও ধর্ম হতে পারে না। অন্যদিকে রাম যুক্তি দিয়ে জানালেন যে, পিতা তাঁকে যা আজ্ঞা করে গিয়েছেন, তা থেকেও তিনি বিচ্যুত হতে পারেন না। এই নিয়ে চলল যুক্তি ও প্রতিযুক্তির অবতারণা। ভরত কাতর প্রার্থনা করে জানাচ্ছেন যে, পুরুষশ্রেষ্ঠ রাম যেন তাঁর মাকে অর্থাৎ কৈকেয়ীকে অপবাদ থেকে রক্ষা করেন। এবং দশরথকেও তাঁর পাপ থেকে মুক্ত করেন। অন্যদিকে রামের যুক্তি, তিনি যেমন পিতৃসত্য পালনের জন্য বনবাসে এসেছেন। তেমনই পিতৃসত্য রক্ষার্থেই ভরতের রাজ্য গ্রহণ করা উচিত। তাতেই তাঁদের পিতা দশরথ ঋণমুক্ত হবেন বলে রামের মত। তিনি ভরতকে বললেন, ‘তুমি স্বয়ং মানুষের রাজা হও, আর আমি বন্য মৃগদের রাজাধিরাজ হই। তুমি আজ প্রফুল্লমনে পুরুশ্রেষ্ঠ অয্যোধ্যায় যাও, আমিও হৃষ্টচিত্তে দণ্ডকারণ্যে প্রবেশ করি।’ এইভাবে মতবিনিময় চলতে থাকে। কিছুতেই রামকে রাজ্য গ্রহণে রাজি করাতে পারছেন না ভরত। এমনকী জাবালি যখন এই নিয়েকথা বলতে গেলেন, তখন রাম বেশ ক্রুদ্ধই হলেন। তখন আসরে নামলেন মহর্ষি বশিষ্ঠ। তিনিও রামকে রাজগ্রহণের পক্ষেই বললেন। কিন্তু রাম জানালেন, পিতা দশরথ যা আজ্ঞা করেছেন, তা তিনি মিথ্যা হতে দিতে পারেন না। ঠিক এইখানেই ঘটল ধরনার ঘটনা। এরপরেই ভরত করলেন এক কাণ্ড। তিনি কুশের আসন বিছিয়ে বসে পড়লেন। উদ্দেশ্য এই যে, যতক্ষণ না রাম তাঁর দাবি মেনে নেবেন ততক্ষণ তিনি উঠবেন না। এখানে যে শব্দটি প্রয়োগ হল, তা ‘প্রত্যুপবেশন’। রাজশেখর বসু এই ঘটনাকে ‘ধরনা’ দেওয়া বলেই ইঙ্গিত করেছেন। হেমচন্দ্র ভট্টচার্যের অনুবাদে এই ঘটনাটি কীরকম?- ‘তখন ভরত নিতান্ত বিমনা হইয়া সন্নিহিত সুমন্ত্রকে কহিলেন, সুমন্ত্র! তুমি শীঘ্র এই স্থানে কুশাসন আস্তীর্ণ করিয়া দেও, যাবৎ আর্য রাম প্রসন্ন না হন, তদবধি আমি ইঁহার উদ্দেশে প্রত্যুপবেশন করিব। … যতক্ষণ না ইনি প্রতিগমন করিবেন, অনাহারে এই পর্ণকুটীরের সম্মুখে শয়ন করিয়া থাকবে।’ অর্থাৎ আজ আমরা ধরনা বলতে যা বুঝি, সেদিন সেই মুহূর্তে তাই-ই হয়েছিল।
আরও পড়ুন: হনুমান কি সত্যিই ‘বাপ তুলে’ কথা বলতেন! কী জানাচ্ছে বাল্মীকির রামায়ণ?
অধিকার আদায়ের আন্দোলনের এই রূপটির আদি চিহ্ন তাই রামায়ণেই মেলে। রবীন্দ্রনাথ যে মহাকাব্যকে ইতিহাস বলেছিলেন, সে উপাধি যে যথার্থ, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।