মাছে-ভাতে বাঙালি- এই যেন বাঙালির পরিচয়পত্র। রোগীর পথ্য হোক কি বিয়ের তত্ত্ব, মাছ ছাড়া বাঙালির চলে না। আর তাদেরই নাকি বারণ করা হচ্ছে মাছ খেতে! ধর্মের নিদান, নাকি মানুষের তৈরি এইসব বিধিনিষেধ? মাছ খাওয়া প্রসঙ্গে কী লেখা আছে বিভিন্ন পুরাণে? শোনাচ্ছেন, শৌভিক সরকার।
মাছ খেতে ভালোবাসে বলে বেচারা বাঙালির ভারী মুশকিল। সারা ভারতের নালিশ শুনতে শুনতে প্রাণ তার ওষ্ঠাগত। কেউ বলে ‘মছলিখোর’ তো কেউ নাক সিঁটকায় মাছের গন্ধ বিচ্ছিরি বলে। আর শুভকাজে মাছ হাজির করলে তো একঘরে হওয়ার জোগাড়। এ কথাও সত্যি, যে, ভারতের অন্যান্য প্রদেশে ব্রাহ্মণদের মাছ খেতে তেমন দেখাই যায় না। সত্যিই কি তবেমাছ খাওয়ার ওপর রয়েছে কোনও ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা?
যে অঞ্চল জুড়ে আছে খাল-বিল-নদ-নদী, সেখানকার মানুষের খাদ্য সংগ্রহের একটি উৎস অবশ্যই জল। এই নদীমাতৃক সভ্যতায় মাছ যে বাঙালির অন্যতম খাদ্য হয়ে উঠবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই! গুপ্ত কবি, অর্থাৎ ঈশ্বর গুপ্ত লিখছেন,“ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি সকল/ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল”।অথচ ‘আপ রুচি খানা’ প্রবাদ যতই প্রচলিত হোক, বাঙালির মাছ খাওয়া নিয়ে বাকি ভারতের ভারী আপত্তি।
আরও শুনুন : বাঙালির নাকি মাছ খাওয়া বারণ! কী বলছে পুরাণ?
সেইদশ কি এগারো শতকে বাঙালি ব্রাহ্মণের মাছের পাত বাঁচাতে আসরে নেমেছিলেন অনেকেই। স্মৃতিকার ভবদেব ভট্ট বলেছিলেন, মনু-যাজ্ঞবল্ক্য-ব্যাস প্রমুখ গুণীজন কেবল বিশেষ কয়েকটি তিথি ও বারে মাছ খেতে বারণ করেছেন।অন্যান্য দিনে মাছ খেতে সমস্যা কোথায়!
অন্য এক স্মৃতিকার শ্রীনাথাচার্যওবিষ্ণুপুরাণ থেকে দুটি শ্লোক উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন যে, বিশেষ কয়েকটি তিথি ছাড়া বাঙালি ব্রাহ্মণেরও মাছমাংস খাওয়া মোটেই বারণ ছিলনা। বৃহদ্ধর্মপুরাণও একরকম বাঙালিকে মাছ খাওয়ার ছাড়পত্রই দিয়েছে।ব্রাহ্মণদের কী কী মাছ খাওয়ার পারমিশন মিলছে এখানে?রুই, পুঁটি, শোল এবং যে-কোনো সাদা ও আঁশযুক্ত মাছ। কেউ কেউ বলেন,বাঙালির মৎস্যপ্রেম এমনই তীব্র যে, ব্রাহ্মণদের মাছ খাওয়ার সুবিধার্থেই তৈরি করা হয়েছিল একটি সংস্কৃত শ্লোক। যার অর্থ, ইলিশ, খলসে, ভেটকি, মাগুর ও রুই- এই পাঁচটি মাছকে নিরামিষ বলে ধরা হবে।
আরও শুনুন : jalebi: জিলিপি নাকি ভিনদেশি? অমৃতির বাড়িই বা কোথায়!
মুনি-ঋষিরা যখন মাছ খাওয়া নিয়ে বিশেষ আপত্তি জানাচ্ছেন না, বরং সুস্বাদু মাছগুলিকে পাতে, থুড়ি পেটে তোলার সুবিধাই করে দিচ্ছেন, তাহলে শাক দিয়ে মাছ ঢেকে ফেলার আর কী দরকার!
আর কেবল সংস্কৃত পুরাণ-শ্লোক ইত্যাদিতে তো নয়, বাংলার প্রাচীন সাহিত্যের দিকে তাকান, সেখানেও দেখবেন মাছের জয়জয়কার।কৃত্তিবাস ওঝা রামায়ণে উল্লেখ করলেন রুই আর চিতল মাছের।পূর্ববঙ্গের লোক বিজয়গুপ্ত ‘মনসামঙ্গল’-এ লিখলেন, “মৎস্য কাটিয়া থুইল ভাগ ভাগ।/ রোহিত মৎস্য দিয়া রান্ধে কলতার আগ”। এছাড়া রয়েছে ডুমো ডুমো করে কাটা মানকচু দিয়ে শোলমাছের পদ, মাগুর মাছের ঝুরি, আছে ফালা ফালা করে কাটা ইলিশ মাছে ‘দক্ষিণসাগর কলা’দিয়ে রান্নার সরস উল্লেখ। ময়মনসিংহের কবি দ্বিজ বংশীদাস আবার লিখেছেন, “বড় বড় কই মৎস্য, ঘন ঘন আঞ্জি।/জিরা লঙ্গ মাখিয়া তুলিল তৈলে ভাজি”। মুকুন্দ চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ খুল্লনা শোল মাছের কাঁটা বেছে আম দিয়ে যে মাছের পদটি রান্না করেছিলেন, আজও বাঙালির হেঁশেলে তা ‘আমশোল’ নামে পরিচিত। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে লিখছেন, “মাছের ডিমের বড়া মৃতে দেয় ডাক”, অর্থাৎ মৃত মানুষকেও নাকি ডেকে তোলার ক্ষমতা ধরে। তাহলেই বলুন, মৃতসঞ্জীবনীর জন্য বাঙালিকে কেনই বা যেতে হবে সেই গন্ধমাদন পর্যন্ত! হাতে, থুড়ি পাতে মাছ তো আছেই।