তিনি ঈশ্বর। তিনি পৃথিবী। তিনি আমাদের ভালোবাসা। শচীন তেণ্ডুলকর। যে নামের সামনে নতজানু ভারতবাসী। আগেও ছিল, এখনও আছে। গোটা বিশ্ব যে বিস্ময় প্রতিভাকে স্মরণ করে সম্ভ্রমে। তাঁরই ৫০তম জন্মদিনে সংবাদ প্রতিদিন-এর আয়োজন ‘বাহ্ শচীন’। নিরলস সাধনায় যে সাধক দেশকে এনে দিয়েছেন অনন্ত ঐশ্বর্য, তাঁকেই ফিরে ফিরে দেখা স্বজন, সতীর্থদের চোখে। আসুন মেতে উঠি এই শচীন পার্বণে।
সুনীল গাভাসকর: প্রথমে স্যর ডন ব্র্যাডম্যান। দুইয়ে স্যর গারফিল্ড সোবার্স। আর ঠিক তার পরেই আমাদের শচীন তেণ্ডুলকর!
ভাবলে অবিশ্বাস্যই লাগছে যে, ১৯৮৭ সালে যে গালফোলা, শিশুসুলভ মুখের ছেলেটাকে দেখেছিলাম, তার আজ পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হচ্ছে! অবশ্যই ছেলেটা আর গালফোলা নয়। এখন পেশিবহুল চেহারা তার। কিন্তু মুখটা একইরকম শিশুসুলভ আছে। সেটা আরও বেশি করে মনে হয়, ঝরঝরিয়ে ছেলেটা হাসে যখন।
মুম্বই ক্রিকেটের চালচিত্র এখন লোকগাথা হয়ে গিয়েছে। নতুন কোনও প্রতিভার সন্ধান পেলে ময়দানের মাঠ-ঘাট, জিমখানায় তা আগুনের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আর তারপর সৃষ্টি হয় সংশ্লিষ্ট সেই প্রতিভাকে নিয়ে আগ্রহ। লোকে কাজকর্ম শেষ করে ঠিক সেই ক্রিকেটারের খেলা দেখতে সময় বার করে চলে আসে। প্রতিভা ক্ষণজন্মা হলে তাকে নিয়ে প্রথমে ফিসফাস শুরু হয়। আর সেই প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটতে থাকে যত, ফিসফাস তত বদলে যায় গর্জনে। দ্রুতই রাস্তাঘাট, জিমখানার কাট্টায় সবাই জেনে যায় যে, ‘স্পেশ্যাল ওয়ান’ চলে এসেছে। এসেছে এমন একজন, যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা যায়।
আরও শুনুন:Sachin@50: চাপ সামলানোর ক্ষমতা ছিল ঐশ্বরিক, আমরা শচীনকে দেখেই শিখি
স্কুল পর্যায়ে শচীনের তাণ্ডব সম্পর্কে পড়েছিলাম আমি। কিন্তু ওর খেলা দেখিনি। হেমন্ত ওয়াইঙ্গাঙ্কর আমার ভাইয়ের মতো ছিল। দুঃখের সঙ্গে ‘ছিল’ লিখতে হচ্ছে, কারণ ও আর বেঁচে নেই। আমাকে হেমন্তই সোৎসাহে এসে বলত, খুদে শচীনের কথা। ১৯৮৭ সালে বাইসেন্টিনারি টেস্ট ম্যাচের জন্য লন্ডন যাচ্ছি, এয়ারপোর্ট যাওয়ার রাস্তায় সুযোগ পেতেই শচীন নিয়ে কথা শুরু করে দিল হেমন্ত। গাড়ি ও-ই ড্রাইভ করছিল। সেই গাড়িতে অনিল যোশীও ছিলেন। আলোচনা শুনে উনি বললেন যে, শচীনের নাকি বেশ মনখারাপ যে, মুম্বই ক্রিকেট সংস্থার সেরা জুনিয়র ক্রিকেটারের পুরস্কার ও পায়নি বলে। কী মনে হয়েছিল সেদিন কে জানে, এয়ারপোর্ট পৌঁছে কাগজ-পেন জোগাড় করে গাড়ির বনেটের উপর শচীনের উদ্দেশে সেদিন একটা চিঠি লিখেছিলাম। লিখেছিলাম যে, হতাশায় ভেঙে না পড়ে পরিশ্রম চালিয়ে যেতে। সঙ্গে এটাও লিখেছিলাম, এমন একজন ক্রিকেটার আছে, যার নাম অতীতে কখনও সেই পুরস্কার তালিকায় ওঠেনি। কিন্তু তাই বলে টেস্ট ক্রিকেটে সে খুব খারাপও করেনি!
আরও শুনুন: Sachin@50: শচীন সর্বোত্তম ক্রিকেট-শিল্পী, ওঁর ব্যাটিং লতা মঙ্গেশকরের গানের মতোই
কয়েক মাস পর দেশে রিলায়েন্স বিশ্বকাপের আসর বসল, আর আমি সর্বপ্রথম দেখলাম শচীনকে। ওয়াংখেড়েতে বিশ্বকাপের যে সমস্ত ম্যাচ পড়েছিল, তাতে ‘বল বয়’ ছিল শচীন। তা আমি ওকে ভারতীয় ড্রেসিংরুম নামক ‘মন্দিরে’ নিয়ে গিয়ে বাকিদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম।
রিলায়েন্স বিশ্বকাপের পর আমি ক্রিকেট খেলার পাট চুকিয়ে দিয়েছিলাম। তবে এটা খেয়াল করেছিলাম যে, অল্পবয়সি ক্রিকেটারদের মধ্যেল শচীনই একদম হালকা লেগগার্ড ব্যটবহার করে, যা কিনা আমি করতাম। তা, আমি যেহেতু খেলা ছেড়ে দিয়েছিলাম, তাই আমার লেগগার্ড ওকে পাঠিয়ে দিতে দু’বার ভাবিনি। দিন কয়েক পর ওয়াংখেড়ে গিয়েছি। রনজি প্রাথমিক টিমের প্র্যাকটিস চলছে। শচীন নেটে ব্যাট করছে। ড্রেসিংরুমে বসে চুপচাপ শচীনের ব্যাটিং দেখছিলাম। ওকে বুঝতে না দিয়ে যে আমি ওর খেলা দেখছি। সেদিন দেখেছিলাম, জোরে বোলারদের খেলার জন্য অনেক বেশি সময় থাকছে শচীনের হাতে। যেদিকে ইচ্ছে বোলারদের মারছে ও! মনে আছে, সেদিন বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে বলেছিলাম, সত্যিকারের স্পেশ্যাল প্রতিভার খেলা দেখে এসেছি আজ। তখনও শচীন স্কুল পর্যায়ের ক্রিকেটার, মুম্বইয়ের হয়ে রনজি তখনও খেলেনি ও। দিন কয়েক পর অফিস থেকে ফেরার পর আমার স্ত্রী বলল, ‘‘একটা বাচ্চা ছেলে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। নিশ্চয়ই তুমি যার কথা বলছিলে আগের দিন, সে। একবারও চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। টানা মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বলছে।’’
ছেলেটা শচীনই ছিল। যে এসেছিল, আমার পাঠানো লেগগার্ডের জন্য ধন্যবাদ দিতে। মনে আছে, আমাকে একটা ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ লেখা কার্ড দিয়েছিল সেদিন শচীন। যার উপর নিজের নাম ‘ব্লক লেটার্সে’ লেখা। কার্ডে ওকে সই করে দিতে বলায় প্রায় দুর্বোধ্য ভাষায় সই করেছিল শচীন। যা দেখে বলেছিলাম, ‘‘তুমি স্যর ডনের সই দেখেছ? গারফিল্ড সোবার্স বা আমাদের বিজয় মার্চেন্টের সই দেখেছ? খেলা ছেড়ে দেওয়ার এত দিন পরেও ওঁদের সই সবাই দেখলেই চিনতে পারে। তোমার সই এমন হওয়া উচিত যাতে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর ভক্তরা দেখে বলতে পারে, এটা শচীন তেণ্ডুলকরের অটোগ্রাফ।’’ শচীন শুনে প্রথমে মাথা নাড়ল, তারপর যে প্রশ্নটা করল, মাটিতে শুইয়ে দেওয়ার মতো! ও আমাকে পালটা জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘‘ঠিক আছে। কিন্তু এ সমস্ত সই জাল করা কি সহজ নয়?’’ শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েছিলাম। কী করব, একটা চোদ্দো বছরের ছেলে প্রবল ঘাবড়ে বলছে যে, তার সই ভবিষ্যতে জাল হয়ে যেতে পারে!
বহু, বহু বছর পর আমার ফ্ল্যাটে সংস্কার চলার সময় শচীনের সেই দুর্বোধ্য সই করা কার্ড আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম আরও অনেকগুলো স্মারকের সঙ্গে। এখন ভাবলে মনে হয়, সত্যিই তো শচীনের সই জাল এখন সহজেই যে কেউ করে দিতে পারে। আর সেই সই পেলে ক্রিকেট নেশাড়ুরা যথেষ্ট উল্লসিতও হবে।
খেলা ছাড়ার পর তত দিনে একটা কাজ আমি, হেমন্ত আর অনিল মিলে শুরু করে দিয়েছিলাম। শচীন যেখানে যেখানে খেলতে যেত, যেখানে যত বোলার পেটাত, সব আমরা বসে বসে দেখতাম। আমরা ভাবতাম, শচীন আমাদের সম্পত্তি, ও যে কত ভাল, তা একমাত্র আমরা জানি। কিন্তু তত দিনে শচীন নিয়ে ক্রিকেটবিশ্বও গা ঝাড়া দিয়ে উঠছিল। আর দ্রুতই আমরা বেজার মুখে স্বীকার করতে বাধ্যা হয়েছিলাম যে, শচীন মোটেই শুধুমাত্র আর আমাদের সম্পত্তি নয়। ও এখন বিশ্বক্রিকেটের সম্পত্তি।
আরও শুনুন: Sachin@50: তুলিতে শচীনের হাতেখড়ি আমার বাড়িতেই
হেমন্ত আর অনিল সবসময় আমাকে শচীনের স্কোর পাঠাত। প্রতিটা ম্যাচের। কোন বোলার ছিল বিপক্ষে, কেমন ব্যাট করেছে শচীন, সমস্ত কিছুর খুঁটিনাটি পাঠাত। আর শুধুমাত্র ক্রিকেট নয়, কোন অনুষ্ঠানে শচীন কী পরছে, কার সঙ্গে কথা বলছে, সব কিছু নিয়ে কথা বলছে, সব কিছু নিয়ে কথা বলতাম আমরা। সন্ধের দিকে অনুষ্ঠান থাকলে, একটা হাতা গোটানো সাদা শার্ট পরত শচীন, আর আমরা আলোচনা করতাম যে, কিশোর হয়েও এরকম ফ্যাকাশে সাজগোজের মানে কী? এর বছর কয়েক পরের কথা। হেমন্ত আমাকে ফোন করে অনিলকে ধরিয়ে দিয়েছে। আর অনিল ওর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় চেঁচিয়ে বলছে, ‘‘স্যর, স্যর, বিগ নিউজ স্যর, বিগ নিউজ। শচীন ফাংশনে প্রিন্টেড শার্ট পরেছে!’’ সেই প্রথম নিজের সাদা শার্ট শিকেয় তুলে রেখে অন্য কিছু পরেছিল শচীন। আর আমরা তৃপ্তির সঙ্গে তিনজন মিলে হাসাহাসি করেছিলাম যে, যাক শেষ পর্যন্ত একঘেয়ে সাদা শার্ট বাদ দিয়ে একজন কিশোরের মতো পোশাক পরেছে ও। শচীন এখন নিখুঁত সাজগোজ করে আর মাঝে মাঝেই আমাকে ওর নিজের ব্র্যান্ড থেকে জামাকাপড় পাঠায়ও।
হেমন্ত আর নেই আমাদের মধ্যেে। কিন্তু অনিল আর আমার এখনও কথা হয়। আমরা এখনও শচীনকে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করি। মনে রাখবেন, শচীনের এত বড় ক্রিকেটার হয়ে ওঠার পিছনে আমাদের অবদান শূন্য। কিন্তু ওর প্রতিভাকে চিনতে পেরেছি বলে, সেই প্রতিভাকে মর্যাদা দিতে পেরেছি বলে ভেতরে ভেতরে একটা প্রবল তৃপ্তি কাজ করে। দেখে ভাল লাগে যে, এত বড় ক্রিকেটার হওয়ার পরেও, এত সাফল্য পাওয়ার পরেও ওর পা আজও মাটিতেই আছে। দেখুন, নিখুঁত ক্রিকেটার বলে কিছু হয় না। নিখুঁত ক্রীড়াবিদ বলেও কিছু হয় না। কিন্তু নিখুঁত ব্যাটারের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকবে শচীন। টেকনিক্যালি কিছু কিছু বদল ও করেছে। ব্যাকলিফটে, পিক আপ আর ফলো থ্রুয়ে। একইসঙ্গে ওর ক্রিকেটবোধও তুখোড়। শচীনের ক্রিকেট মস্তিষ্ককে যদি ব্যবহার না করা হয়, তাহলে তাতে ক্রিকেট নামক খেলাটার ক্ষতি, ওর নয়।
মুম্বই ক্রিকেটে নতুন কোনও প্রতিভা এলে তার নামকরণ হয়। আর আমরা তেমন কিছু না ভেবেই ওর নামকরণ করেছিলাম ‘তেণ্ডলা’। তেণ্ডলা এখন পঞ্চাশ। আর ওর সেঞ্চুরির যা খিদে, তাতে জীবনের বাইশ গজেও যে সেঞ্চুরি আসবে, তা নিয়ে আমি নিশ্চিত।
শচীনকে, ওর পরিবারকে, পঞ্চাশতম জন্মদিনের রাশি রাশি শুভেচ্ছা।