বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতকে একবার বলা মাত্রই চাকরি হয়েছিল তাঁর। সেই কর্মস্থলেই তাঁকে এসে নিমন্ত্রণ জানিয়ে যান স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নেহরু। তিনিই আবার প্রবাদপ্রতিম গায়িকা বেগম আখতারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। স্বাধীনতা দিবসে উর্দু খবর শোনা গিয়েছিল তাঁরই গলায়। তিনি, দেশের প্রথম মহিলা নিউজ রিডার তথা সংবাদপাঠিকা, সাইদা বানো। আসুন, শুনে নেওয়া যাক এই আশ্চর্য নারীর কথা।
ঘরে বানানো ব্রাউন ব্রেডে নিজের হাতে মাখন লাগাচ্ছিলেন যিনি, সেসময়ে তাঁর অঙ্গুলিহেলনেই চলে গোটা দেশ। তিনি স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। অথচ কোনও বেয়ারা কিংবা খানসামা নয়, সামনে বসা মহিলার প্লেটে নিজের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছিলেন তিনি। ওই মহিলাই যে আজ সকালে প্রধানমন্ত্রীর ব্রেকফাস্ট টেবলের সম্মানিত অতিথি! নেহরু নিজে তাঁর অফিসে গিয়ে তাঁকে বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, রোজ সকালে অফিসে ছুটতে হয় বলে ভাল করে খাওয়াদাওয়া হয় না এই যুবতির। সেই কারণেই এমন আকস্মিক নিমন্ত্রণ।
আরও শুনুন: যুযুধান দু-দেশে ফিরুক শান্তি, সেই বার্তা নিয়েই সাতাশ বছরে ‘হিন্দ-পাক দোস্তি মেলা’
খোদ পণ্ডিত নেহরু যাঁকে নিজের বাসভবনে আমন্ত্রণ জানান, কে এই মহিলা?
তাঁর পরিচয়, একটা ছোট্ট চুড়ির আওয়াজ। রেডিওতে সকালের খবর শুরু হওয়ার আগে যে রিনরিন শব্দটুকু কানে আসে। যে সময়ে সংবাদপাঠকদের মুখ দেখা যেত না, কেবল গলা শোনা যেত, এ সেই যুগের কথা। ওই শব্দটুকু যেন ইঙ্গিত। যা শুনে রেডিওর গায়ে কান পেতে থাকা শ্রোতারা বুঝতে পারতেন, খবর পড়বেন সাইদা বানো। দেশের প্রথম মহিলা সংবাদপাঠিকা।
আরও শুনুন: অঞ্জনের গানে নয়, বাস্তবেও ছিলেন বেলা বোস, চেনেন সেই সাহসিনীকে?
সাইদা প্রথমে কাজ করতেন লখনউ রেডিও স্টেশনে। প্রবাদপ্রতিম শিল্পী বেগম আখতারকে লখনউয়ের অভিজাত সমাজে পরিচিত করিয়েছিলেন সাইদা-ই। এমনকি ইশতিয়াক আব্বাসির সঙ্গে তাঁর বিয়ের ঘটকালিও করেন। আবার সেই বিয়ে ভাঙার পর অবসাদে ডুবে যাওয়া বেগম আখতারকে ফের গানের দুনিয়ায় ফিরিয়ে এনেছিলেন সাইদা।
আরও শুনুন: জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেই শুরু হয় প্রতিদিনের কাজ, দেশপ্রেমের অনন্য নজির এই গ্রামে
বিয়ে ভেঙেছিল তাঁর নিজেরও। দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক পাঁচ দিন আগে, লখনউ থেকে বিদায় নিয়ে যখন নতুন শহরে এসে পা রাখলেন সাইদা, তখন তাঁর সঙ্গে কেবল দুই শিশুপুত্র। বিচারপতি আব্বাস রাজার সঙ্গে দশ বছরের বিবাহিত জীবনে আইনিভাবে ইতি পড়েছিল সেই বছরেই। সাইদার বয়স তখন মাত্র ২৭। এরপরে আইনজীবী এবং পরবর্তীতে দিল্লির মেয়র নুরুদ্দিন আহমেদ-এর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন তিনি। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে চলেছিল সেই সম্পর্ক। কিন্তু আর বিয়ের বাঁধনে নিজেকে জড়াননি সাইদা।
বিবাহবিচ্ছেদের জেরেই আসলে লখনউ ছাড়তে চেয়েছিলেন সাইদা। সেই সূত্রেই ভেবেছিলেন খোদ রাজধানীর অল ইন্ডিয়া রেডিও স্টেশনে কাজ করার কথাও। যেখানে তখনও পর্যন্ত কোনও মহিলাকে খবর পড়ার জন্য বহাল করা হয়নি। নিজের জীবনের মতোই, এই ক্ষেত্রেও ছক ভেঙে দেন সাইদা বানো। বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতকে ইচ্ছের কথা জানাতেই, ব্যবস্থা হয়ে যায়। ১৩ অগস্ট সকালে, দিল্লির অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে প্রথমবারের জন্য ভেসে আসে মহিলা কণ্ঠে সংবাদপাঠ।
যখন দেশের অধিকাংশ মেয়ের জীবন অন্দরমহলের বাইরে আসার সুযোগ পেত না, সেই সময়ে সব বাঁধা ছক ভেঙেচুরে নিজের শর্তে জীবন বেঁচেছিলেন সাইদা। খানদানি মুসলিম পরিবারের মেয়ে সব রক্ষণশীলতার পর্দা উড়িয়ে একা গাড়ি চালাতেন। নতুন শহরে এসে বাস করতে শুরু করেছিলেন একাই। সম্পর্কও বেছে নিয়েছেন নিজেই। কাটিয়েছেন সিঙ্গল মাদারের জীবন। আর এই সবকিছু মিলিয়েই বিপুলসংখ্যক মানুষের সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন এই সাহসী মহিলা।