একটি বই। আর তার জেরে জারি হওয়া একটি ফতোয়া। এই দুইয়ের কারণেই প্রায় রাতারাতি বদলে গিয়েছিল সলমন রুশদির জীবন। প্রায় ৩৩ বছর আগে জারি হওয়া সেই ফতোয়ার জের যেন এখনও চলছে। সম্প্রতি নিউ ইয়র্কের এক অনুষ্ঠানে হামলা চলে লেখকের উপর। চিকিৎসকরা বলছেন, এই হামলার জেরে একটি চোখ নষ্ট হয়ে যেতে পারে তাঁর। এই সবকিছুর মূলে আছে একটি ফতোয়া, যা প্রায় আমূল বদলে দিয়েছিল রুশদির জীবন।
মৃত্যুর হুমকি তাঁর জীবনে নতুন নয়। বিগত তিন দশকের বেশি সময় ধরে এই হুমকি নিজের সঙ্গে বয়ে নিয়ে চলেছেন তিনি। সলমন রুশদি। বিশ্বসাহিত্যে এই নাম যেমন সমীহের জন্ম দেয়, তেমনই জন্ম দিয়েছে বিতর্কেরও।
আরও শুনুন: বরযাত্রীর ছদ্মবেশে অভিযান আয়কর গোয়েন্দাদের, মহারাষ্ট্র থেকে উদ্ধার বিপুল টাকা ও সোনা
প্রায় পাঁচ দশক ধরে সাহিত্যচর্চায় মগ্ন রুশদি। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’, সম্মানিত হয়েছিল বুকার পুরস্কারে। তবে, রুশদিকে বিতর্কিত করে তোলে তাঁর চতুর্থ উপন্যাস ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’। উপন্যাসটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষোভে ফেটে পড়ে ইসলামিক দেশগুলি। দাবি ছিল, এই উপন্যাসে হজরত মহম্মদকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তা ইসলামের পক্ষে অবমাননাকর। রুশদির বিরুদ্ধে ওঠে ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাতের অভিযোগ। ১৯৮৯ সালে রুশদির বিরুদ্ধে জারি হয় ফতোয়া। ইরানের তৎকালীন সর্বেসর্বা খোমেইনি সরাসরি রুশদির মৃত্যু দাবি করে। একই দাবি ওঠে বইটির প্রকাশকের ক্ষেত্রেও। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশে খোমেইনির বার্তা ছিল, রুশদির প্রাণনাশ করতে গিয়ে যদি কারও মৃত্যু হয়, তবে সে ‘শাহদত’ লাভ করবে, অর্থাৎ তার ঠাঁই হবে জন্নতে। সেই থেকে প্রায় রাতারাতি জীবন পালটে যায় বুকারজয়ী ঔপ্যনাসিকের। আত্মগোপন করতে হয় তাঁকে। জোসেফ অ্যান্টন ছদ্মনাম নিয়ে রুশদি বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে থাকতে শুরু করেন। জানা যায়, ফতোয়া জারির প্রথম ছ-মাসের মধ্যেই অন্তত ৫৬ বার নিজের আশ্রয়স্থল বদল করতে হয়েছিল রুশদিকে। ১৯৯৩ সালে খোমেইনি পুনরায় এই ফতোয়ার কথা ঘোষণা করে। ফলত আত্মগোপনের জীবনই যেন শিরোধার্য হয়ে গিয়েছিল রুশদির ক্ষেত্রে। নিরাপত্তার বেষ্টনীর মধ্যেই কাটত জীবন। সম্প্রতি সেই নিরাপত্তাকে কার্যত অকেজো করেই লেখকের উপর হামলা চালাল মৌলবাদীরা।
আরও শুনুন: যুযুধান দু-দেশে ফিরুক শান্তি, সেই বার্তা নিয়েই সাতাশ বছরে ‘হিন্দ-পাক দোস্তি মেলা’
তবে, রুশদি একা নন, ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’-এর জন্য হামলার শিকার হতে হয়েছিল তাঁর প্রকাশক এবং অনুবাদকদেরও। ১৯৯১ সালে বইটির জাপানি অনুবাদকের উপর চলে হামলা। অধ্যাপক হিতোশি ইগারাশি জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন রুশদির এই ঐতিহাসিক উপন্যাসটি। এর জেরেই প্রাণ দিতে হয় তাঁকে। নিজের অফিসেই ছুরিকাঘাতে মৃত্যু হয় তাঁর। বইটির ইটালীয় অনুবাদক এত্তেরো ক্যাপ্রিওলোর উপরও ছুরি নিয়ে হামলা চালায় মৌলবাদীরা, যদিও তিনি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। গুলি চালানো হয়েছিল বইটির নরউইজিয়ান ভাষার অনুবাদক উইলিয়াম নাইগার্ডের উপরও। ১৯৯৮ সাল থেকে রুশদির উপর জারি হওয়া ফতোয়া একরকম অকেজো হয়ে যায়। তবে, তাতে যে পরিস্থিতি বিশেষ বদলায়নি, সাম্প্রতিক হামলাই তাঁর প্রমাণ। খোমেইনির বার্তা ছিল, রুশদির বিরুদ্ধে জারি ফতোয়া আসলে একটা বুলেটের মতো, যা একবার নিক্ষিপ্ত হয়েছে মানে তা লক্ষ্যে বিঁধবেই। মৌলবাদী সেই হিংসা-বিদ্বেষ যে এখনও জিইয়ে আছে পুরোমাত্রায়, রুশদিকে ছুরিকাঘাত করে সে কথাই যেন জানিয়ে দিল হামলাকারী। সারা বিশ্বের সাংস্কৃতিক পরিসর এই হামলার নিন্দা করেছে। তবে, তিন দশক পরেও যেভাবে ধর্মীয় মৌলবাদ সংস্কৃতিকে আঘাত করছে, তা সামগ্রিক ভাবে গোটা বিশ্বের জন্যই চিন্তা এবং ভয়ের।