সর্বগ্রাসী ভূমিকম্প এসে শেষ করে দিয়েছে সবকিছু। ধ্বংস, ভগ্নস্তূপ, মৃত্যুতে- আফগানিস্তান যেন খণ্ডহর। সেই বিধ্বস্ত দৃশ্যের মাঝেই যেন একটুখানি জীবনের খোঁজে ফিরে ফিরে আসে একটা ছোট্ট কুকুর। খুঁজে ফেরে তার মালিককে। আর সে-ছবি দেখেই নেটদুনিয়া যেন নতুন করে বুঝতে পারছে ভালোবাসার অর্থ।
ছোট্ট, লোমশ দেহ। দু-চোখে একরাশ বিষণ্ণতা। একটা ভাঙা বাড়ির দিকে নির্ণিমেষ তাকিয়ে আছে ছোট্ট একটি কুকুর। এ-ছবির ভিতর হয়তো আহামরী তেমন কিছুই নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও আছে এমন কিছু, যা আর্ত সময়ে দাঁড়িয়েও মানুষের হৃদয়কে করে তুলেছে আর্দ্র। এ-দৃশ্য আফগানিস্তানের। এই তথ্যটুকুই আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে অনেক কিছু, বুঝিয়ে দিচ্ছে কেন এই দৃশ্য হয়ে উঠেছে এতখানি হৃদয়গ্রাহী। অতিসম্প্রতি ভয়াবহ ভূমিকম্পে মৃত্যুপুরী হয়ে উঠেছে আফগানিস্তান। ধ্বংস আর মৃত্যু যেন সে-দেশকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। আর সেই মৃত্যুপুরীর ভিতর জীবনের অপেক্ষায় যেন দিন গুনছে এই পোষ্যটি।
আরও শুনুন: ঘরের ছাদ, দেওয়াল নেই… তবু হোটেল ভাড়া ২৬ হাজার টাকা, কেন জানেন?
সম্প্রতি টুইটারে এই সারমেয়টির ছবি পোস্ট করেছেন এক মহিলা। জানিয়েছেন, যে-বাড়ির পোষ্য এই সারমেয়, সেই বাড়ি ভেঙেচুরে ধুলোয় মিশে গিয়েছে। ভূমিকম্পে প্রাণ হারিয়েছেন বাড়ির সকলেই। শুধু বরাতজোরে প্রাণে বেঁচেছিল পোষ্যটি। এখন সে বলতে গেলে আশ্রয়হীন, স্বজনহারা। অবশ্য প্রতিবেশীদের কেউ কেউ তাকে দেখে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাইয়েছে-দাইয়েছে, যত্ন-আত্তি করেছে। কিন্তু তাতেও যে মন মানেনি একরত্তি সারমেয়র! যে-অঞ্চলে ভূমিকম্পের প্রভাব ছিল সবথেকে বেশি, সেখানকারই এক গ্রামের ভাঙা একখানা বাড়ির সামনে প্রতিদিন ফিরে ফিরে আসে কুকুরটি। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে চারপাশ। হয়তো বুঝতে পারে না, প্রাণচঞ্চল বাড়িটি কী করে নিমেষে এমন ভগ্নস্তূপে পরিণত হল! কোথায় গেল এই বাড়ির সকল লোকজন! ভগ্নস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে তার বিষণ্ণ দুই চোখে খুঁজে ফিরে পুরনো সেই দিনের কথা। হয়তো অপেক্ষা করে তার মালিকের ফিরে আসার। ছোট্ট প্রাণীটি এখনও হয়তো উপলব্ধি করতে পারেনি যে, যা হারিয়ে গিয়েছে তা আর কখনোই ফিরে আসে না।
আরও শুনুন: এবার ইন্টারনেট ছাড়াও পাঠানো যাবে ই-মেল, এল চমকপ্রদ ‘Gmail Offline’ ফিচার
মৃত্যুর কালো ছায়া এড়িয়ে কিঞ্চিৎ স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে আফগানিস্তানের জীবনযাত্রা। তবে এই অভিঘাত সামলে ওঠা সহজ নয়। গোটা দেশের বিপন্ন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যেন আরও ক্ষতিগ্রস্ত হল এই ভূমিকম্পে। কিন্তু তা ছাড়াও, এই যে এত মৃত্যু, প্রতিবেশী-পরিজনহীন হয়ে পড়া মানুষের মিছিল, সামাজিক পরিসরেও এর একটা বড় প্রভাব আছে। এক অদ্ভুত শূন্যতা যেন বয়ে বেড়াচ্ছে সে-দেশের বাতাসে। এই কুকুরটি যেন সেই শূন্যতারই প্রতিনিধি। আর তাকে দেখে নেটপাড়ার মানুষ আর-একবার নতুন করে উপলব্ধি করছেন ভালোবাসার অর্থ। কুকুর প্রভুভক্ত – এ-কথা কে না জানে! কিন্তু এ তো শুধু ভক্তি নয়। যখন মালিকই অনুপস্থিত, যখন অন্যত্র মিলছে যথেষ্ট আদরযত্ন, তখনও যে সে তার পুরনো আশ্রয়, পুরনো মানুষের খোঁজে প্রতিদিন ভগ্নস্তূপের সামনে ফিরে ফিরে আসে, এ শুধু ভক্তির গুণে হতে পারে না। কেউ কেউ তাই বলছেন, একেই বোধহয় ভালোবাসা। এই মানুষের সমাজেও তো দেখা যায়, উপকারীর উপকার স্বীকার না-করার প্রবণতা। ভালবাসাহীন মানুষ এক অন্যকে আঘাত করে প্রতিনিয়ত। সেখানে এই সারমেয় যেন মানুষকে নতুন করে মনে করিয়ে দিতে পেরেছে ভালোবাসার ভিতরকার সারসত্য। যেভাবে কুকুরটি তাকিয়ে আছে ভাঙা বাড়ির দিকে, নেটদুনিয়ার বহু মানুষ তাই সেভাবেই যেন তাকিয়ে দেখছেন ছোট্ট সারমেয়টিকে। হয়তো উপলব্ধি করছেন, একটি ছোট্ট প্রাণীও সময়বিশেষে দিয়ে যেতে পারে কত গভীর শিক্ষা! আর তাই তাঁদের মধ্যেই কেউ কেউ লিখেছেন, আমরা মানুষরা বোধহয় কুকুরদের ‘ডিজার্ভ’ করি না! সত্যিই কি তাই! শুধু আয়নার সামনে নয়, একরত্তি প্রাণীটি মানুষকে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সেই ভাবনার সামনেও।