প্রায় হাজার দেড়েক নাবালিকা বিয়ে রুখে দিয়েছেন তিনি। শারীরিক অত্যাচার ও যৌন হেনস্তার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন অসংখ্য মেয়েকে। একঘরে করে দেওয়া, ধর্ষণের হুমকি, খুনের ভয় দেখানো, কোনও কিছুই দমিয়ে রাখতে পারেনি তাঁকে। দেশের মেয়েদের সামনে দাঁড়িয়ে অক্লান্ত যোদ্ধার মতো লড়াই করে চলেছেন ডক্টর কৃতি ভারতী। আসুন, শুনে নেওয়া যাক তাঁর কথা।
মেয়ে হয়ে জন্মেছেন বলে শৈশবেই তাঁর মুখে তুলে দেওয়া হয়েছিল বিষ। যে পরিবারের কাছে মেয়েরা এমন অবাঞ্ছিত, সেই পরিবারের পরিচয় বহন করে চলতে চাননি কৃতি। ভারতের মেয়ে কৃতি নিজের নামের সঙ্গে জুড়ে নেন দেশের নাম। নিজেই নিজের পদবি রাখেন, ভারতী। আর ছোটবেলার সেই বিষাক্ত অভিজ্ঞতাকে জিইয়ে রেখে দেশের এমন অসহায় মেয়েদের বাঁচানোর চেষ্টা শুরু করেন তিনি।
আরও শুনুন: ভিক্ষার অর্থেই প্রতিপালন হাজারের বেশি পথশিশুকে, নজির গড়েছিলেন নিরাশ্রয় সিন্ধুতাই
সরকারের তরফে যতই বেটিদের বাঁচিয়ে রাখার কথা বলা হোক না কেন, ভারতে কন্যাভ্রূণ হত্যার পরিসংখ্যান এখনও ভয় ধরায়। বিশেষ ধরে কৃতির জন্মভূমি রাজস্থানে। সেখানে মেয়েদের ভাগ্যে লেখা থাকে জন্মের পরেই খুন হয়ে যাওয়া। যারা বাঁচে, পুতুলখেলার বয়সেই নিজের চেয়ে অনেক বড় কোনও পুরুষের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় তাদের। তারপর থাকে প্রতিদিনের অত্যাচারের কিসসা। কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে এই ভাগ্যলিপিকে বদলে দিয়েছিলেন কৃতি। তাঁর জন্মের আগেই বাবা অন্য সংসার পেতেছিলেন। একঘরে হয়ে যাওয়া মা ইন্দু আর মেয়ে কৃতির লড়াই চলে তারপর থেকেই। অবশেষে উচ্চশিক্ষা শেষ করে সাইকোলজিতে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন কৃতি। আর এরপরেই, নিজের লড়াইয়ের পথটা তিনি খুলে দিতে চান অন্য মেয়েদের জন্যেও।
আরও শুনুন: জেসিবি থেকে রোড রোলার, চালাতে পারেন সবই! ইঞ্জিনিয়ারিংও পড়ছেন ৭১ বছরের বৃদ্ধা
কলেজে পড়ার সময় থেকেই একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় যোগ দিয়েছিলেন কৃতি। সাইকোলজির শিক্ষা কাজে লাগিয়ে অত্যাচারিত মেয়েদের কাউন্সেলিং করতেন তিনি। তাঁর কাছে প্রথম এসেছিল একটি ধর্ষিতা মেয়ে, যার বয়স মাত্র ৯ বছর। এখানে কাজ করতে গিয়ে কৃতি দেখতে পান, কেবল ধর্ষণ নয়, নাবালিকাদের বিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও রাজস্থান রীতিমতো এগিয়ে। কাউন্সেলিং-এর সাময়িক আশ্বাস যে এদের কোনও দীর্ঘমেয়াদি সুরাহা দিতে পারবে না, তা বুঝতে পেরেছিলেন কৃতি। তাই ২০১১ সালে ‘সারথি ট্রাস্ট’ নামে নিজের একটি সংস্থা খোলেন তিনি। যে সংস্থা তৃণমূল স্তরে গিয়ে কাজ করবে, এইসব মেয়েদের আশ্রয় দেবে, প্রয়োজনে তাদের হয়ে আইনি লড়াই লড়বে। আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমেই ২০১২ সালে লক্ষ্মী সারগারা-র বাল্যবিবাহ রদ করে দেন কৃতি। মাত্র এক বছর বয়সে বিয়ে হওয়া লক্ষ্মীকে তার অনভিপ্রেত দাম্পত্য থেকে মুক্তি দেন কৃতি। লক্ষ্মী সারগারা মামলা-ই ভারতে প্রথম কোনও বাল্যবিবাহ রদ হওয়ার নজির।
এতদিন ধরে আইনের পথে লড়াই চালিয়ে কৃতি এবং তাঁর সংস্থা অন্তত ৪১টি বাল্যবিবাহকে রদ করতে পেরেছে। অন্তত ১৪০০ মেয়ের ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ হওয়ার আগেই রুখে দিতে পেরেছেন তাঁরা। যৌন নির্যাতনের শিকার শিশু এবং মহিলাদের মানসিক চিকিৎসাও করে কৃতির সংস্থা। এ ছাড়া এইডস আক্রান্ত মেয়েরা, সমাজ যাদের ঠাঁই দেয় না, তাদেরও নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠেছে ‘সারথি ট্রাস্ট’। শিশুশ্রমিকদেরও উদ্ধার করে সমাজের মূল স্রোতে ফেরানোর চেষ্টা করে চলেছে এই সংস্থা।
আরও শুনুন: দেশে প্রথম মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা, লড়াইয়ের অপর নাম সাবিত্রীবাই ফুলে
ইউনিসেফ-এর ২০০৯ সালের হিসেব অনুযায়ী, পৃথিবীর মোট বাল্যবিবাহের ৪০ শতাংশই ঘটে এই দেশে। সেই লজ্জা মুছে ফেলার জন্য নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছেন কৃতি এবং তাঁর মতো আরও অনেক মানুষ। তাঁরা জানেন, পথ এখনও অনেকটা বাকি। তবুও নতুন পথ গড়ে আর পথ দেখিয়ে চলেছেন কৃতি ভারতীরা।