রামায়ণে কুম্ভকর্ণের কাহিনি তো সকলেরই জানা। রাবণের এই মহাবীর ভাইটি একটানা ছ-মাস ধরে ঘুমোতেন। কানের কাছে ঢাক ঢোল বাজলেও তাঁর ঘুম ভাঙত না। কিন্তু বাস্তবে কি কেউ এমন দীর্ঘদিন ধরে ঘুমোতে পারে? হ্যাঁ, এহেন ঘটনাই সত্যি হয়ে গিয়েছে এই মেয়েটির জীবনে। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
রূপকথায় পড়া যায় ঘুমন্ত পুরীর রাজকন্যের কথা। তার মাথার কাছে থাকে সোনার কাঠি, আর পায়ের কাছে রুপোর কাঠি। রাজপুত্র এসে সেই কাঠি অদলবদল করে তার ঘুম ভাঙায়। কিন্তু এই মেয়েটির ঘুম যে কোন মন্ত্রে ভাঙবে, ১০ বছর ধরে ভেবে ভেবেও তা বুঝে উঠতে পারেননি তার মা, আত্মীয় পরিজন, এমনকি চিকিৎসকেরাও।
আরও শুনুন: স্বামীকে খুন করার উপায় নিয়ে লিখেছিলেন প্রবন্ধ, বাস্তবে খুনিই সাব্যস্ত হলেন লেখিকা
হ্যাঁ, একদিন দুদিন নয়, গুনে গুনে ১০টি বছর ধরে নিঃসাড়ে ঘুমিয়ে ছিল মেয়েটি। যখন ঘুমিয়েছিল, তখন সে ছিল মাত্র ১১ বছর বয়সের এক কিশোরী। আর যখন ঘুম ভাঙল, ততদিনে সে পূর্ণ যুবতি। তার বয়স তখন ২১ বছর। অথচ তার মানসিক বয়স তখনও এগারোতেই আটকে রয়েছে। মাঝের এই ১০টি বছর কোনও চিহ্ন না রেখে মুছে গিয়েছে তার জীবন থেকেই।
কী হয়েছিল ঠিক?
এলেন স্যাডলার নামের এই মেয়েটি ১৮৫৯ সালে জন্মেছিল ব্রিটেনের এক ছোট্ট গ্রামে। ১২ ভাইবোন নিয়ে বিরাট পরিবারে বড় হয়ে উঠছিল সে। একদিন রাতের খাওয়া সেরে রোজকার মতোই শুতে গিয়েছিল সকলে। কিন্তু পরদিন সকলে নিয়মমাফিক বিছানা ছেড়ে উঠলেও এলেন আর ওঠে না। রাম-রাবণের যুদ্ধের সময় কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙাবার জন্য যেরকম আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছিল, ঠিক সেইভাবেই, ঘুম ভাঙাবার সবরকম পদ্ধতিই প্রয়োগ করা হয় এই মেয়েটির উপরে। কিন্তু কিছুতেই কোনও ফল মেলেনি। এদিকে সে যে জীবন্ত, সে কথা বোঝা যাচ্ছিল। ঘুমন্ত মেয়েকে অতি কষ্টে তরল পদার্থ খাইয়ে দিতেন তার মা। তাতেও আবার আরেক মুশকিল, একসময় এলেনের চোয়াল আটকে যায়। মা অবশ্য তাতেও হাল ছাড়েননি। দাঁতের ফাঁক দিয়ে খাবারের জোগান দেওয়া জারি রেখেছিলেন তিনি।
আরও শুনুন: খুদের মাছ ধরার ভিডিওতেই লুকিয়ে জীবনের সাফল্যের মন্ত্র, চিনিয়ে দিলেন আনন্দ মাহিন্দ্রা
এলেনের কথা জানাজানি হতেই তাকে দেখার জন্য টুরিস্টদের ভিড় বাড়তে থাকে। তার কী হয়েছে কেউ না জানলেও অনেকেই তাকে সারিয়ে তোলার জন্য টাকা দিতে চাইত। ‘স্লিপিং গার্ল’ নামে খ্যাত এলেনের মাথার একটা চুল পাওয়ার জন্যও টাকার থলি নিয়ে ভিড় জমাত লোকজন। এদিকে এলেনের বাবা তার ছোটবেলাতেই মারা গিয়েছিলেন। এইসবের মধ্যে মারা যান তার মা-ও। মায়ের মৃত্যুর পাঁচ মাস পরে ঘুম ভেঙে চোখ খোলে এলেন স্যাডলার। বাস্তব পৃথিবীটার সঙ্গে তাল মেলাতে স্বাভাবিকভাবেই বেশ অসুবিধা হয়েছিল তার। কারণ, শরীরের বয়স প্রকৃতির নিয়মে বেড়ে গেলেও তার মনের বয়স যে একদিনও বাড়েনি।
আসলে, এলেনের যা হয়েছিল, তার নাম ট্রাইপ্যানোসোমায়াসিস। চলতি কথায়, স্লিপিং সিকনেস। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান এই রোগকে চিহ্নিত করতে পেরেছে। এলেন-ই এই রোগে প্রথম আক্রান্ত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু উনিশ শতকে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা আজকের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। ফলে এলেনের ঠিক কী হয়েছে, কোনও চিকিৎসকই সে কথা বুঝে উঠতে পারেননি।
রোজকার ধরাবাঁধা জীবন, বাড়াবাড়ি রকমের কাজের চাপ, দুশ্চিন্তা-উদ্বেগ, সবকিছু থেকে সাময়িক রেহাই দেয় ঘুম। আমরা অনেকেই তাই ঘুমের মধ্যে আশ্রয় খুঁজি। কিন্তু ঘুম যে আশীর্বাদের বদলে অভিশাপ হয়েও উঠতে পারে, নিজের জীবন দিয়ে সে কথা প্রমাণ করে দিয়েছিল এই মেয়েটিই।