যুদ্ধ হচ্ছে সুদূর ইউক্রেনে। এদিকে হাতের মুঠোয় ধরা মোবাইলে সেই যুদ্ধের ছবি, ভিডিও ক্রমাগত দেখছে বিশ্ববাসী। আপাত ভাবে আমরা যুদ্ধ থেকে দূরেই আছি। কিন্তু আসলে যেন তা নয়। মোবাইল নামক যন্ত্রটির দৌলতে আমরা আসলে যুদ্ধের খুব কাছাকাছিই আছি। যুদ্ধের ছবি বা ভিডিও কি আমাদের মনের উপর কোনও প্রভাব ফেলছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিশ্চয়ই ফেলছে। তাহলে আমাদের কী করণীয়? আসুন শুনে নিই।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটা ছবি বা নিউজ চ্যানেলে দেখানো একটা-দুটো ভিডিও নয়। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে এই মুহূর্তে বহুসংখ্যক যুদ্ধের ভিডিও আমাদের হাতের মুঠোয়। ইচ্ছেয় হোক বা অনিচ্ছেয়, এমরা সেগুলো দেখছি, দেখেই চলেছি। সোশ্যাল মিডিয়ায় সাধারণ ভাবে স্ক্রল করলেই এরকম বহু ভিডিও আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সাধারণত সংবাদমাধ্যম যে ছবি বা ভিডিও দেখানো হয়, তার নেপথ্যে থাকে চিন্তাভাবনা। কোনও ছবি বা ভিডিও সাধারণ মানুষের উপর কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তা বিবেচনা করেই এই ধরনের কন্টেন্ট প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় সেরকম কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আবার এই সময়ে দাঁড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়াকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। ফলত, এই ধরনের ভিডিও আমরা দেখেই ফেলছি।
আরও শুনুন: যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে আটকে স্ত্রী, গাড়ি নিয়ে পাঁচ দেশ ঘুরে উদ্ধারের চেষ্টা স্বামীর
আপাত ভাবে মনে হচ্ছে এতে আলাদা করে আমাদের মনের উপর তেমন কোনও প্রভাব পড়ছে না। বাস্তব কিন্তু তা নয়। যুদ্ধের ভিডিও আর পাঁচটা সাধারণ ভিডিও-র মতো নয়। ফলে এর একটা নেতিবাচক প্রভাব আমাদের মনের উপর এসে পড়েই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একে ‘সেকেন্ডারি ট্রমা’ বলা যায়। অর্থাৎ যে ট্রমা আসলে অন্য কারও। কিন্তু পরোক্ষ ভাবে আমরাও তার ভুক্তভোগী। কেউ কেউ এতে হয়তো সামান্য প্রভাবিত হচ্ছেন। কেউ বা হচ্ছেন না সেভাবে। মনে রাখতে হবে, স্ট্রেস নেওয়ার ক্ষমতা সকলের সমান নয়। তাই কম বেশি হলেও সকলেই প্রভাবিত হচ্ছেন। এই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া তাই কোনও কাজের কথা নয়। কেননা যে কোনও ভয়াবহতা আমাদের মানসিক ভাবে খানিকটা ক্ষতিগ্রস্ত করেই। যুদ্ধের এই ভিডিও সেখানে ব্যতিক্রম কিছু নয়। এই প্রভাব হাতেনাতে হয়তো টের পাওয়া যাচ্ছে না। তবে যাঁদের মনের উপর এর ছায়াপাত ঘটছে, তাঁদের মধ্যে বেশ কিছু অস্বস্তিকর লক্ষণ ক্রমশ ফুটে উঠতে দেখা যায়। হয়তো রাতে ঘুমের সমস্যা হচ্ছে, বা ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে উঠছেন- এগুলোই জানান দেয় যে মনের উপর প্রভাব পড়েছে। অনেকে আবার অ্যালকোহলের মাত্রা অকারণেই বাড়িয়ে ফেলেন। আপাত ভাবে তিনি নিজেও বুঝতে পারেন না যে, কেন এরকমটা করছেন! কিন্তু এর নেপথ্যে থেকে যাচ্ছে ওই ভয়াবহ বাস্তবতা আর তা থেকে মুক্তির ইচ্ছা।
আরও শুনুন: রুশ কবল থেকে বাঁচাতে হবে শহর! ব্যস্ত হাতে ব্যারিকেড গড়ছে একদল খুদে
বিশেষজ্ঞরা তাই বলছেন, এরকম সময়ে দুটি জিনিস খুব জরুরি। প্রথমত, সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায় যদি ঘোরাঘুরি করতেই হয়, তাহলে এই ধরনের ভিডিও যে দেখতে হবে, তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখা। কারণ যুদ্ধের সময় এরকম ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে আসবেই। তা আটকানো সহজ নয়। আর মানসিক ভাবে খানিকটা প্রস্তুতি থাকলে নিজেকে সামলানো যায়। দ্বিতীয় বিষয়টি মাথায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। যদি কোনও কিছু আপনাকে বিব্রত করে, বিরক্ত করে – তবে সবার আগে তা স্বীকার করে নিতে হবে। অন্যের উপর প্রভাব পড়ছে না বলে, নিজের অস্বস্তি লুকিয়ে ফেলার কোনও প্রয়োজন নেই। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি, মানুষের মৃত্যু বা অঙ্গহানি, বাচ্চাদের উপর নেমে আসা নৃশংসতা ইত্যাদি সাধারণ ভাবে আমাদের প্রভাবিত করে। সম্ভব হলে তা না দেখাই ভালো। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, এরকম সমস্যা দেখা দিলে পরিজন বা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কথা বলা উচিত। সবার আগে সমস্যাটি নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করা জরুরি। পাশপাশি মাথায় রাখা জরুরি যে, শব্দ আমাদের উপর খুব প্রভাব ফেলে। তাই ভিডিওর শব্দ মিউট করে রাখা উচিত। তাতে প্রভাব খানিকটা কমে। এ ছাড়া মোবাইল বা কমপিউটর থেকে নিয়মিত বিরতি নেওয়া জরুরি। যাতে যুদ্ধের সময়কার সব ভিডিও আমাদের চোখের সামনে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ভেসে না ওঠে।
এ কথা ঠিক যে, যুদ্ধ না থামলে এর প্রতিকার কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু কোন অঙ্কে যে যুদ্ধ থামবে, তা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। তাই এক্ষেত্রে নিজেদেরই সচেতন হতে হবে। যত্ন নিতে হবে নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের।