পুরি যাওয়ার পথে তাঁদের গ্রামে পরিব্রাজক, সাধুরা আসতেন। তাঁরা থাকতেন অতিথিশালায়। বালক গদাধর তাঁদের সঙ্গে মিশে যেতেন। তাঁদের জন্য জল তুলে দিতেন, রান্নার কাঠ সংগ্রহ করে দিতেন। অর্থাৎ সাধুসেবা করতেন। আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁদের কাছে থেকে শুনতেন ঈশ্বরপ্রসঙ্গ।
যুবক নরেন্দ্রনাথ যে যুক্তি দিয়ে বিচার না করে, সহজে কিছু বিশ্বাস করতেন না, এতে ঠাকুর সন্তুষ্টই হতেন। অনেক ঘটনাতেই তার প্রমাণ মিলেছে। ঠাকুরের কথায় গোড়ায় অবিশ্বাস করেছেন নরেন্দ্রনাথ। পরে ঠাকুর নিজের পদ্ধতিতে তাঁকে ফিরিয়ে এনেছেন বিশ্বাসের পথে। তবে এই যে নিজের মতো করে সব বুঝে নেওয়া, এ যেন ছিলও ঠাকুরের মজ্জাগত। ঠাকুরকে সেই সময়ে যে দেখেছেন, তিনিই বিস্মিত হয়েছেন। মানুষটি আশ্চর্য সমন্বয়ের সাধক। অপ্রয়োজনীয় সংস্কারকে পরিত্যাগ করেন এক নিমেষে। এই যে স্বভাব, এ যেন একেবারে ছোটবেলা থেকেই ছিল ঠাকুরের। ধরাবাঁধা কোনও কিছুকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তাঁর ছিল ঘোর অনীহা।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১৭): ঠাকুরের বাল্যজীবনেই ঘটেছিল কিছু অদ্ভুত ঘটনা
একেবারে বালক যখন ঠাকুর, তখন বিদ্যালয়ের পড়াশোনাকে খুব একটা ভালভাবে মেনে নিতে পারেননি। বিদ্যালয়ের পড়াশোনাত বিন্দুমাত্র রস পেতেন না গদাধর, আর গণিত শাস্ত্রে তো নয়ই। অনেকেই ধারণা করে থাকেন, বুদ্ধির কারণেই বালক গদাধরের এরকম আচরণ ছিল না। অর্থাৎ স্পষ্ট কথায় বলতে গেলে, গদাধর লেখাপড়ায় ভালো ছিল না। কিন্তু সত্যিই কি এটাই একমাত্র কারণ! আমরা দেখব, ঠাকুরে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রামকুমার চট্টোপাধ্যায় যখন কলকাতায় এসে টোল খুলেছিলেন, তখন গদাধর এসেছিলেন সে টোলে। তখন অবশ্য বালক নয়, গদাধরে কিশোর, বয়স সতেরো বছর। গদাধর স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, এই চাল-কলা-বাঁধা বিদ্যে লাভ করার কোনও বাসনা তাঁর নেই।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১৬): ঠাকুর চোরকে বলেন চুরি করতে, গৃহস্থকে বলেন সজাগ থাকতে!
এই কথাটা আমাদের খেয়াল করতে হবে। অর্থাৎ যে বিদ্যা শুধু চাল-কলার ব্যবস্থা করে, তাতে তাঁর আর কতটুকু শিক্ষালাভ হবে! অর্থাৎ এখানে ঠাকুর যে শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, তাকে আজকের ভাষায় আমরা চাকুরিমুখী শিক্ষাব্যবস্থা বলতে পারি। পরবর্তীকালেও দেখা যায়, পাণ্ডিত্যের প্রতি ঠাকুরের খুব একটা সদর্থক মনোভাব ছিল না। কেননা তাঁর মতে, অন্তঃসারশূন্য পাণ্ডিত্য আসলে আধ্যাত্মিক পথে প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে। ওতে হিতে বিপরীত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ইত্যাদি নিয়ে তিনি তাই পরিহাস করতেও ছাড়তেন না। ভক্তিহীন পাণ্ডিত্য যে ক্ষতিকর, তা বিশ্বাস করতেন ঠাকুর। একেবারে ছোটবেলা থেকেই এ ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা ছিলেই বিশ্বাস।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১৫): উপনয়নের সময়ই সংস্কারের বেড়া ভেঙেছিলেন বালক গদাধর
বাল্যকাল থেকেই গদাধরের শিক্ষা-প্রয়াস তাই ছিল অন্যরকম। তিনি অনন্তকে জানতে চান। ঈশ্বর লাভ করতে চান। তাই বাঁধাধরা ছকে-ফেলা পড়াশোনা তাঁর জন্য নয়। বিকল্প ব্যবস্থা কী? প্রচলিত তো সেরকম কিছু ছিল না। বালক গদাধর নিজের মতো করে নিজের শিক্ষার একটা ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন বলা যায়। পুরি যাওয়ার পথে তাঁদের গ্রামে পরিব্রাজক, সাধুরা আসতেন। তাঁরা থাকতেন অতিথিশালায়। বালক গদাধর তাঁদের সঙ্গে মিশে যেতেন। তাঁদের জন্য জল তুলে দিতেন, রান্নার কাঠ সংগ্রহ করে দিতেন। অর্থাৎ সাধুসেবা করতেন। আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁদের কাছে থেকে শুনতেন ঈশ্বরপ্রসঙ্গ। সাধুদের কাহিনি, তীর্থের মাহাত্ম্য, ধর্মের নানা প্রসঙ্গ যত শুনতেন বালক গদাধর, তত তাঁর অন্তর আনন্দে পূর্ণ হয়ে উঠত। পর্যটক জীবনের রহস্যে তাঁর বালকমন হত আচ্ছন্ন। মহাত্মাদের জীবনের কথা কল্পনা করে সনাতন জীবনধারার যে রীতি, মহিমা তা শিখে ফেলেছিলেন তিনি। এই শিক্ষা তো কোনও বিদ্যালয় তাঁকে দিতে পারে না। অথচ যে আধ্যাত্মিক পথে অগ্রগতির ইচ্ছা তাঁর, সেখানে এই জ্ঞানই তো প্রয়োজনীয় ছিল। ঠাকুর নিজের মতো করেই নিজেকে সেই বিষয়ে শিক্ষিত করে তুলেছিলেন। কোনও বাঁধা নিয়মের খাঁচায় গিয়ে ঢোকেননি। আর তাই উত্তরকালে তাঁর যে মতামত, সেখানেও কোনও গোঁড়ামির আশ্রয় ছিল না।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১৪): অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, বুঝলেন নরেন্দ্রনাথ
পরবর্তীকালে যুবক নরেন্দ্রনাথের মধ্যেও তিনি এই গুণ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। করেছিলেন বলেই, জগতের প্রয়োজনে তাকে তৈরি করে নিয়েছিলেন জগতের সেবার জন্য।