মানুষ যেন এখন দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। একদল, মাস্ক পরছেন। আর-একদল কিছুতেই মাস্ক পরছেন না। হাজার বলেকয়ে, বুঝিয়ে-সুঝিয়েও লাভ নেই। চারিদিকে যখন করোনা নিয়ে এত সতর্কতা, তখন কিছুসংখ্যক মানুষের মাস্ক পরায় কেন এত অনীহা! স্রেফ আলস্য! নাকি সত্যিই এর নেপথ্যে কাজ করে কিছু গভীর ভাবনা! আসুন শুনে নেওয়া যাক!
সুকুমার রায়ের রামগরুড়ের ছানার সেই বিখ্যাত পঙক্তির অনুকরণেই একদল মানুষের সম্পর্কে আজ বলা যায় – মাস্ক পরার কথা শুনলে বলে, পরব না না না না! ব্যাপারটা যদিও আর মজার পর্যায়ে নেই। মাস্কবিহীন বেপরোয়া মানুষের জন্য বহু মানুষের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা সংকটে। কিন্তু হুঁশ ফিরলে তবে তো! একদল মানুষ যেন ঠিক করেই নিয়েছে, যে যাই বলুক, মাস্ক মুখে তুলবেন নাই-ই।
আরও শুনুন: কুশপুতুল দাহ থেকে হরেক রঙের অন্তর্বাস পরা, অদ্ভুত রীতিতে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয় বিশ্বে
যাঁরা নিয়মিত মাস্ক পরেন, স্বাস্থ্যবিধি পালন করেন, তাঁরা ভেবেই পান না, কিছু মানুষ এসবের পরোয়া করেন না। স্বভাবতই তাঁদের রাগ হয়। এই নিয়ে পথেঘাটে বচসাও যে কম হচ্ছে তা নয়। কিন্তু তাতে সুরাহা কিছু হয় না। বাস-ট্রামে বা বর্ষবরণের উৎসবে সেই একই ছবি। তবে কি যাঁরা মাস্ক পরেন না, তাঁরা একেবারেই সচেতন নয়? এই যে করোনার বাড়বাড়ন্ত, ওমিক্রনের আতঙ্ক – এর কোনওকিছুই কি তাঁদের স্পর্শ করে না! দেখা যাচ্ছে, এমন মানুষ আছেন বটে। তবে তাঁরা সংখ্যায় খুব বেশি নন। বর্তমান সময়ে যখন গণমাধ্যম নানা ভাবে মানুষের কাছে খবর পৌঁছে দিচ্ছে, তখন এই বিপদ সম্পর্কে অজানা থাকার কথা নয় বেশিরভাগ মানুষেরই। উপরন্তু সরকারি স্তর থেকেও সচেতনতা প্রসারে একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মানুষের মাস্ক পরা বা না-পরার অভ্যাস নিয়ে যাঁরা ভাবনা চিন্তা করছেন, সেইরকম সমীক্ষক ও বিশেজ্ঞদের অনেকেই মনে করছেন, এতকিছুর পরেও এই বিপদ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন এমন মানুষের দেখা মেলা ভার। সেক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়, বিপদ সম্পর্কে প্রায় সকলেই সচেতন। প্রশ্ন উঠছে জেনেশুনেও তাহলে মানুষ মাস্ক পরছেন না কেন? উত্তরে যে কথাটি উঠে আসছে, তা যথেষ্ট ভাবনার। সমীক্ষদের মতে, এই শ্রেণির বেশিরভাগ মানুষই সচেতন কিন্তু উদাসীন। অর্থাৎ, তাঁরা জানেন যে মাস্ক না পরলে তাঁদের বিপদ হতে পারে, তাঁর থেকে অন্য আর-একজনেরও বিপদ হতে পারে, তা সত্ত্বেও তাঁরা বিষটিকে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেন না।
আরও শুনুন: বছর ঘুরলেই পালটে যায় ক্যালেন্ডারও, কীভাবে শুরু হয়েছিল এই দিনপঞ্জি?
এহেন ঔদাসীন্যের নেপথ্যে আবার কিছু কারণ থেকে যায়। যেমন, ভুল জানা বা সঠিক না-জানার জন্য ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। ধরা যাক, কোনও একজন মানুষ শুনলেন যে, তাঁর এলাকায় করোনার প্রাদুর্ভাব নেই, অন্য এলাকায় হয়েছে। তিনি সেক্ষেত্রে হয়তো ততটা স্বাস্থ্যবিধি মানায় জোর দিলেন না। কিংবা কেউ একজন জেনেছেন, সংক্রমণ হয়েছে, কিন্তু তার মৃত্যুহার ততটা নয়। এক্ষেত্রেও তিনি স্বাস্থ্যবিধিতে ঢিলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই সবই হচ্ছে আংশিক জানার ফল। অন্ধের হস্তিদর্শনের মতোই করোনার বিপদের খানিকটা খানিকটা করে তাঁরা জেনেছেন এবং সেই কারণেই উদাসীন থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আরও শুনুন: নতুন বছরেও সঙ্গী করোনার ভয়, তাহলে ডিপ্রেশনকে দূরে রাখবেন কীভাবে?
আবার মানুষের মন নিয়ে যাঁদের কারবার, সেই বিশেজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ডিনায়াল বা অগ্রাহ্য এখানে একটা বড় ফ্যাক্টর। অর্থাৎ, যা বলা হচ্ছে তা অস্বীকার করা। যেহেতু সংক্রমণ রুখতে মাস্ক পরাকে বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে, সরকারি স্তর থেকে মাস্ক পরতে বলা হচ্ছে, এমনকি সমাজের এক শ্রেণির মানুষরাও এ নিয়ে জোর করছেন, সেহেতু এক ধরনের অগ্রাহ্য করার মনোভাবও জন্ম নিচ্ছে পাশাপাশি। অনেকটা আইন ভাঙার ক্ষেত্রে যে মনোবৃত্তি কাজ করে, এখানেও তারই প্রতিফলন।
আরও শুনুন: ওমিক্রনের ভয়, তার মধ্যেই বাড়িতে পার্টির আয়োজন! মাথায় রাখুন এই বিষয়গুলি
আবার অনেকে বলেন মাস্ক পরলে নানারকম অসুবিধা হয়। তাই তাঁরা মাস্ক পরেন না। অসুবিধা যে হয় তা তো সত্যি। সেক্ষেত্রে বহু মানুষ তো অসুবিধা মেনে নিয়েই মাস্ক পরেন। তাহলে বাকিরা পরছেন না কেন? এক্ষেত্রেও মানুষের মন তলিয়ে দেখে বিশেজ্ঞরা বলছেন, এই শ্রেণির মানুষ আসলে নিজেদের স্বার্থের বাইরে কোনও বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তাই করতে চান না। এমনকী তাঁরা এটাও ভুলে যাচ্ছেন না, যে তাঁদের এই ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির কারণে তাঁদের পরিবারের মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এইখানে এসে আবার গভীর ভাবনার অবকাশ থাকছে। আত্মকেন্দ্রিকতা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, যা আসলে মানুষকে কোনও একটি নির্দিষ্ট ইস্যুতে জোটবদ্ধ হতে দেয় না, এখানে ধরা পড়ছে সেই মনোভাবই। একটি গভীর সামাজিক সমস্যারই বাস্তব রূপ ধরা পড়ছে এই মাস্ক না-পরার মধ্যে দিয়ে। সোজা কথায়, সকলেই টিম প্লেয়ার হয়ে উঠতে পারে না। মানুষ যতই নিজেকে সমাজবদ্ধ বলে দাবি করুক না কেন, সেখানেও সব মানুষের মধ্যে একইরকম দায়বদ্ধতা থাকে না। জীবনের নানা ক্ষেত্রেই এ জিনিস লক্ষ্য করা যায়। সমাজতাত্ত্বিকরা সে নিয়ে বিশ্লেষণও করেন। মাস্ক না-পরা আসলে এই দায়বদ্ধতাহিনতারই এক ধরনের উদাহরণ।
তাহলে এক্ষেত্রে কী করণীয়? এক তো সরকারি স্তর থেকে প্রচার। যা ইতিমধ্যেই করা হচ্ছে। আইন বা নিয়মের শাসন কড়া করলে হয়তো কিছুটা ফল মিলবে। আর একটা দিক হল সামাজিক ভাবে মানুষের এগিয়ে আসা। একজন দায়িত্বশীল মানুষকেই তাঁর পাশের জনকে বোঝাতে হবে। জানাতে হবে যে, তাঁর দায়িত্বিজ্ঞানহীনতার কারণে তাঁর নিজের, পরিবারে এবং সমাজের কতবড় ক্ষতি করছেন তিনি। তাতে যে সর্বদা কাজ হবে এমন নয়। তবু রাগারাগি বকাবকি বা ব্যাপারটিকে দোষারোপের পর্যায়ে নিয়ে না গিয়ে, এইভাবে বুঝিয়ে বলায় হয়তো ফল মিলবে, এমনটাই মনে করছেন অনেকে।