রাতের অন্ধকার, শুনশান রাস্তা, গাড়ি নেই তাই ভরসা অ্যাপ-বাইক। হঠাৎ একটা নোটিফিকেশন, চমকে উঠলেন মহিলা। জানা গেল, তাঁর বাইক চালক একজন মহিলা আর সেটা জেনেই এমন চমকেছেন তিনি। যে সময় এক নারী মহাকাশ থেকে ফিরে আসেন, সেই সময় মহিলা বাইক চালক দেখে অবাক হচ্ছেন এক মহিলা? ব্যাপারটা কী? শুনে নেওয়া যাক।
কাজ শেষ হতে রাত হবে। শুনশান রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। আপনি যদি মহিলা হন, তাহলে এই পরিস্থিতি নিয়ে আপনাকে ভাবতেই হবে। বলা ভালো, আপনি ভাবতে বাধ্য হবেন। ২০২৫ সালে দাঁড়িয়েও। দিল্লি, কলকাতা, মুম্বইয়ের মতো বড় শহরে দাঁড়িয়েও। তার ওপর যদি গণপরিবহন না থাকে, ফেরার ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হয়, তাহলে বাড়তি চিন্তা। ভরসা বলতে অ্যাপক্যাব। কিন্তু তবুও যেন কোথাও গিয়ে বাধে। এমনিতে আপনি অভ্যেসই করে ফেলেছেন; চারিপাশ বদ্ধ ট্যাক্সিতে উঠেই বাড়ির লোক বা কাছের বন্ধুদের লোকেশন পাঠিয়ে দেন। পরিচিত কাউকে মিথ্যে মিথ্যে ফোন করে জোর গলায় জানান ট্যাক্সিতে উঠে পড়ার কথা। চালকের থেকে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রাখেন। তবুও… তারপরেও… অপিরিচিত চালকটি যদি একবারের জন্যেও এমন কোনও নতুন রাস্তা ধরেন যেখানে আপনি আগে যাননি, যা আপনার একেবারে অচেনা, তাহলে বুকের মধ্যে কোথাও যেন অজানা ভয় এসে জুড়ে বসে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়। জানলার বাইরে চোখ রেখে হন্যে হয়ে খুঁজতে চান সামান্যতম হলেও চেনা দোকান, চেনা রাস্তা, চেনা সাইনবোর্ড। সুতরাং, বদ্ধ ট্যাক্সি বা ক্যাব নয়! কোনোমতেই না! তবে কি বাইক? নিরাপত্তা সেটায় একরত্তি কম হলেও চারিদিক খোলামেলা। একান্ত বিপদ বুঝলে আত্মরক্ষার চেষ্টা অন্তত করা যাবে। তাই না?
এইসব মাথায় রেখেই অ্যাপের সাহায্যে বাইক সার্ভিস বুক করেছিলেন দিল্লির বাসিন্দা স্মৃতি সাহু। সারাদিনের অফিস শেষে সহকর্মীর সঙ্গে অফিসের প্রয়োজনেই কেনাকাটা করতে গিয়েছিলেন তিনি। কাজ সারতে সারতে যথেষ্ট রাত হয়েছিল। আগেও এমনটা করেছেন। তবে এদিনের ঘটনা অন্যরকম। নাহ না, কোনও বিপদে পড়েননি, স্রেফ অবাক হয়েছেন। প্রথমে অ্যাপে বাইক চালকের নাম দেখে, পরে সেই চালককে সামনে দেখে। আসলে, সেদিন রাতে চালক হিসেবে কোনও পুরুষ নয়, এক মহিলাকে পেয়েছিলেন স্মৃতি।
যাত্রাপথে গল্পে জমে ওঠে দুজনের। মিনিট পঁয়ত্রিশের রাস্তায় স্মৃতি পেয়ে যান এক ভরসাযোগ্য সারথীকে। গল্পে গল্পে তিনি জানতে পারেন, তাঁর সারথী পেশায় রন্ধনকর্মী। প্রাচুর্য্য না থাকলেও, আর্থিক সমস্যা তেমন নেই। তবে বাইক চালাতে বড় ভালোবাসেন। আর সেই টানেই বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। রাতের দিকে যাত্রী হিসেবে মহিলাদেরই বেছে নেন। বলা বাহুল্য, বাইক ড্রাইভারের ভূমিকায় এক মহিলাকে দেখলে রাতের দিল্লি শহরে বহু মহিলা যাত্রীই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। সমগ্র যাত্রাপথে একাধিকবার তিনি জিগ্যেস করে নেন স্মৃতি দেবীকে, যে বাইকের গতিবেগ বা অন্য কোনও কারণে তাঁর কোনওরকম অসুবিধে হচ্ছে কিনা। এহেন পরিষেবায় মুগ্ধ হয়ে তাই রাইড শেষে বাড়ি ফিরেও স্মৃতি দেবী সামাজিক মাধ্যমে উক্ত চালিকাকে ধন্যবাদ জানাতে ভোলেননি।
এ ঘটনা নিঃসন্দেহে আনন্দের। তবু বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়েও যেভাবে মানুষের সাধারণ লিঙ্গ পরিচয় তার সামগ্রিক পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে, তা দেখলে অবাক হতে হয়। যদিও অস্বীকার করবার উপায় থাকে না। নামী, বেনামী সংস্থাভুক্ত বা ব্যক্তিগত অধিকারাধীন ক্যাব তথা জনপরিবহণে ঘটা মেয়েদের যৌন হেনস্থার ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। আর অনেকক্ষেত্রেই এমন ঘটনায় সরাসরি জরিত থাকতে দেখা যায় স্বয়ং গাড়ির চালককে! আর সেখানেই ঘুরে ফিরে আসে অন্য আরও একটি প্রশ্ন, যা গভীরে ভাবতে গেলে রীতিমত অস্বস্তি দেয়। যেকোনওরকম সংস্থার অধীনে রেজিস্টারকৃত বাইক/ ক্যাব চালাতে গেলে হয়তো একশো শতাংশ সময়ে যাত্রী বেছে নেওয়ার বাহুল্য করতে পারবেন না চালিকা। কখনও না কখনও পুরুষ যাত্রীকে বহনের দায়িত্ব নিতেই হবে তাঁকে। সেসব ক্ষেত্রে তিনি কতখানি সুরক্ষিত, তাঁর নিশ্চয়তা স্থির করে দেবে কে?
তাও সমস্ত বাধা পেরিয়ে ভারতের মেয়েরা আজ অনেক বেশি স্বাবলম্বী। সময়ের সঙ্গে তার মাত্রা বাড়বে বই কমবে না। অর্থের প্রয়োজনেই হোক বা শখে, আজ থেকে কয়েক বছর পর হয়তো অ্যাপ ক্যাব বা বাইক ড্রাইভারের ভূমিকায় আরও অনেক বেশি মহিলাকে দেখতে পারব আমরা। তখন হয়তো আর অবাক হবো না, গর্বিত হবো, প্রশান্ত হবো।