পড়াশোনা এগোয়নি বেশি দূর। কিন্তু থেমে যায়নি পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ। আর সেইজন্যই ২৫ বছর ধরে রাস্তায় বসে বই বিক্রি করে চলেছেন এই মহিলা। জিইয়ে রেখেছেন পড়া আর পড়ানোর অভ্যাস। মাতৃভাষার প্রতি ভালবাসা ছড়িয়ে দেওয়াও লক্ষ্য তাঁর। আর এভাবেই নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে তুলেছেন সঞ্জনা তিওয়ারি। হয়ে উঠেছেন এক অন্যরকম লড়াইয়ের মুখ। আসুন, শুনে নেওয়া যাক তাঁর পথচলার কথা।
দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই বিয়ে দেওয়া হয়েছিল মেয়েটির। তার আরও পড়াশোনা করার ইচ্ছেতে কান দেয়নি নিজের বাড়ির লোকই। সেদিনই সে বুঝতে পেরেছিল, মেয়েদের নিজের বাড়ি বলে আসলে কিছু হয় না। তাকে নিজের ভুবন গড়ে নিতে হয় নিজের হাতেই।
সেই লক্ষ্যেই এরপর পা বাড়িয়েছিলেন সঞ্জনা তিওয়ারি। ঠিক করে নিয়েছিলেন, নিজের পরিচয়ে বাঁচবেন তিনি। তাই যত বাধাই আসুক, পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শেষ করেছেন বিয়ের পরেই। আর এখন, এই মধ্যবয়সে পৌঁছে স্নাতকোত্তরে ভরতি হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন সঞ্জনা। আর পড়াশোনার প্রতি নিজের এই আগ্রহ থেকেই কাজের পথটাও খুঁজে পেয়েছিলেন সঞ্জনা। বই না পড়ে থাকতে পারতেন না। তাই দিল্লির শ্রীরাম সেন্টার ফর পারফরমিং আর্টস-এর লাগোয়া রাস্তায় বই বিক্রি করতে বসে পড়েছিলেন তিনি। যাকে বলে একইসঙ্গে রথ দেখা আর কলা বেচা। এই সুযোগে বিক্রির জন্য আনা বইগুলি পড়ে ফেলতেন তিনি।
আরও শুনুন: ভিক্ষার অর্থেই প্রতিপালন হাজারের বেশি পথশিশুকে, নজির গড়েছিলেন নিরাশ্রয় সিন্ধুতাই
তাঁর পসরায় কেবলমাত্র হিন্দি বই-ই থাকে। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন, প্রতিটি মানুষেরই তাঁর মাতৃভাষায় লেখা সাহিত্য সম্পর্কে জানা উচিত। মাতৃভাষা আসলে মায়েরই মতো। তাই কেবল ইংরেজি বই পড়লেই হবে না, নিজের আঞ্চলিক সাহিত্যের স্বাদ পাওয়াও সমান জরুরি বলেই মনে করেন সঞ্জনা। নিজের পসরার প্রত্যেকটি বই তাঁর পড়া। নতুন বইয়ের খবরাখবর কিংবা হিন্দি সাহিত্যের নিত্যনতুন আলোচনা সম্পর্কেও তিনি রীতিমতো ওয়াকিবহাল। কেউ পরামর্শ চাইলে তাই অনায়াসে বই বেছে দিতেও পারেন সঞ্জনা। আলোচনা করতে পারেন বইয়ের ভালমন্দ নিয়ে। তাঁর মতে, ভাল পরামর্শ কমবয়সি পড়ুয়াদের মধ্যে থেকে একজন ভাল পাঠককে বের করে আনতে পারে। এমনকি লেখকদের সম্পর্কে আকর্ষক তথ্য দিয়ে বইয়ের প্রতি আগ্রহ গড়ে তুলতেও তিনি তৎপর। তাঁর কাছে বই বিক্রি কেবল ব্যবসা নয়, বই পড়া এবং পড়ার অভ্যাস ছড়িয়ে দেওয়ার পথ। আর এই আন্তরিকতার কারণেই তিনি সবার ‘SRC আন্টি’। এমনকি লেখকদের অনেকেও সময় সুযোগ মতো ঘুরে যান তাঁর দোকান থেকে। মজার কথা হল, সঞ্জনার স্বামী রাধেশ্যাম তিওয়ারি নিজেও একজন লেখক। এই লেখকেরা অনেকেই তাঁর স্বামীকে চিনলেও, সেই পরিচয়ে তাঁদের প্রভাবিত করতে চান না সঞ্জনা। বরং এই খ্যাতনামা লেখকেরা যে নিজের পরিচয়েই তাঁকে চিনেছেন, একেই তাঁর জীবনের অর্জন বলে মনে করেন সঞ্জনা।
আরও শুনুন: দেশে প্রথম মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা, লড়াইয়ের অপর নাম সাবিত্রীবাই ফুলে
ফুটপাথের বইয়ের দোকানের পাশাপাশি বর্তমানে নিজের নামে একটি প্রকাশনা সংস্থাও খুলেছেন সঞ্জনা। যার মাধ্যমে হিন্দি সাহিত্যের উদীয়মান লেখকদের প্রকাশের পথ করে দিতে চান তিনি। এই কাজগুলিই তাঁর জীবনের পাথেয়। তিনি বলেন, তিনি হয়তো জীবনে খুব বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারেননি, তবে যে সম্মান অর্জন করেছেন তা-ই রয়ে যাবে তাঁর সঙ্গে। নিজের হাতে তৈরি করা নিজের পরিচয়কেই সেই অর্জন বলে মনে করেন সঞ্জনা তিওয়ারি।