তিনি আক্ষরিক অর্থেই রক্ষক। অতিমারির সময় করোনার আঁতুড়-দেশ থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন ভারতীয়দের। এবার দেবদূতের মতো পৌঁছে গেলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে। বাঁচিয়ে আনলেন অসংখ্য ভারতীয় পড়ুয়াকে। অপারেশন গঙ্গা মিশনে অন্যতম কান্ডারি এই বঙ্গতনয়া। আসুন শুনে নিই, কলকাতার মেয়ে মহাশ্বেতার গল্প।
“নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার
কেন নাহি দিবে অধিকার?” সৃষ্টিকর্তার চোখে চোখ দিয়ে এই প্রশ্ন বারবার করতে হয়েছে মেয়েদের। সামনে বাধার পাহাড় বরাবরই ছিল। আর সেই পাহাড় ভেঙেই তৈরি করতে হয়েছিল পথ। সেই পথ ধরেই আলো এসেছে। আসলে লড়াইটা তো সমান অধিকারের। কিন্তু সেই জায়গাটুকুর জন্যও কম লড়তে হয়নি মেয়েদের। একটা সময় তাঁরা ছিলেন অন্তঃপুরবাসিনী। একদিন সেই সংস্কারের বেড়াজাল ভেঙে বেরিয়ে আসেন তাঁরা। ক্রমে সব ক্ষেত্রে সব স্তরে নিজের জায়গা ছিনিয়ে এনেছে মেয়েরা। প্রথা ভেঙেছে, সংস্কার ভেঙেছে। প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে সমস্ত তথাকথিত নিয়মের মুখে।
আরও শুনুন: প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার দিশা দেখিয়েছেন যাঁরা
একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সেনাবাহিনী, পাইলটের কাজের মতো অজস্র ক্ষেত্রই ছিল মেয়েদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে সেই ধারণাটা আমূল বদলে দিয়েছেন গুঞ্জন স্যাক্সেনা বা লক্ষ্মী যোশীর মত মেয়েরা। এবার সেই তালিকায় যুক্ত হল আরও একটা নাম। তিনি কলকাতার মেয়ে মহাশ্বেতা চক্রবর্তী।
১৯৯৯ সালে ইন্দো-পাক কার্গিল যুদ্ধের সময়ে চিতা হেলিকপ্টার উড়িয়ে আহত সেনাদের উদ্ধার করে এনেছিলেন গুঞ্জন সাক্সেনা। তাঁর আগে ভারতীয় বায়ুসেনায় কোনও দিন কোনও মহিলা যুদ্ধে অংশ নেননি। করোনা পর্বে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘বন্দে ভারতে’র অংশ হয়ে প্লেন উড়িয়েছিলেন মুম্বইয়ের মেয়ে লক্ষ্মী। বেজিংয়ে আটকে পড়া অজস্র ভারতবাসীকে দেশে ফিরিয়ে এসেছিলেন তিনি। লক্ষ্মীর মতোই বন্দে ভারত মিশনেও উদ্ধারকারীর ভূমিকায় ছিলেন কলকাতার মেয়ে মহাশ্বেতা। আর এ বার তিনি শামিল হলেন অপারেশন গঙ্গা মিশনেও। প্লেন নিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন থেকে বাঁচিয়ে আনলেন অসংখ্য ভারতবাসী পড়ুয়াদের।
ঘটনাচক্রে ভারতবর্ষ থেকে বহু ছাত্রছাত্রীই পড়াশোনার প্রয়োজনে যান ইউক্রেনে। বিশেষত ডাক্তারির পড়ুয়ারা তো বটেই। হঠাৎ করেই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়া সামরিক অভিযান ঘোষণা করে দেওয়ার পরে বিপাকে পড়েছিলেন তাঁরা। যুদ্ধপরিস্থিতিতে ইউক্রেনের আকাশসীমা বন্ধ থাকায় ভারতীয়দের দেশে ফেরাতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয় উদ্ধারকারী দলকে। যুদ্ধ ঘোষণা হওয়ার পর পরই ভারতীয়দের উদ্ধারে অপারেশন গঙ্গা অভিযান শুরু করে নয়াদিল্লি। আর তারই অংশ হয়ে ইউক্রেনে পৌঁছন ২৪ বছরের পাইলট মহাশ্বেতা।
কলকাতার নিউটাউনের বাসিন্দা সেই মহাশ্বেতার নামই আজ ঘুরছে সকলের মুখে মুখে। ছোটবেলায় কলকাতার অক্সেলিয়াম কনভেন্ট স্কুলে পড়াশোনা, সেখান থেকে ইন্দিরা গাঁধী রাষ্ট্রীয় উড়ান অ্যাকাডেমিতে বিমান চালকের প্রশিক্ষণ। স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল মহাশ্বেতার। বরাবরই আকাশে ডানা মেলে দিতে চেয়েছিলেন তিনি।
আরও শুনুন: করোনাকালে চিনে আটকে দেশবাসী, ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ভারত-কন্যা লক্ষ্মী
গত চার বছর ধরে বেসরকারি বিমান চালিয়ে এসেছেন মহাশ্বেতা। এর মধ্যে হঠাৎই একদিন মধ্যরাতে তাঁর কাছে একটি ফোন আসে। বিমানসংস্থার তরফে তাঁকে জানানো হয়, উদ্ধার অভিযানে ইউক্রেনে যেতে হবে মহাশ্বেতাকে। মাত্র দু ঘণ্টা হাতে সময় ছিল। কোনও মতে গোছগাছ করে রওনা দেন তিনি। ইস্তানবুল হয়ে আড়াই ঘণ্টার রাস্তা পোল্যান্ড। সেখান থেকেই ভারতীয় পড়ুয়াদের উদ্ধার করার কথা ছিল। বেশ কয়েকটি বিমানসংস্থা যোগ দিয়েছিল এই উদ্ধার অভিযানে। অন্তত ৭৫টি বিমান যাতায়াত করেছে তাঁদের ফিরিয়ে আনতে। একবার নয়, একাধিক বার বিমান নিয়ে ভারত-পোল্যান্ড যাতায়াত করতে হয়েছে মহাশ্বেতাকে। তবে তাতে ক্লান্তির ছাপ মাত্র নেই মহাশ্বেতার মুখে।
কোথা থেকে পেলেন এত মনের জোর?
উত্তর দিয়েছেন মহাশ্বেতা নিজেই। জানালেন, বিমানে ওঠার পরে আটকে পড়া ভারতীয়দের জন্য সামান্য জলখাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে পড়ুয়ারা সেসময় এতটাই ট্রমায় ছিলেন, যে সেসব খাবার জল কোনওদিকেই মন ছিল না তাঁদের। তখন তাঁদের একটাই ভাবনা শুধু, কতক্ষণে দেশে ফেরা যায়। অন্য কিছু ভাবেননি মহাশ্বেতারাও। কখনও খাবার জুটেছে, কখনও জোটেনি। শুধু কালো কফি আর বিস্কুট খেয়েই হয়তো থাকতে হয়েছে সারাটাদিন। একেকদিন তো ১৫-১৬ ঘণ্টা ককপিটে থাকতে হত তাঁদের।
তবু যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে আটকে পড়া মানুষগুলোর আতঙ্কের কাছে এ যেন কিছুই নয়। যেভাবে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে তাঁরা পোল্যান্ডে পৌঁছেছেন, তা ভাবলেও শিহরণ হয়। আর সেই মানুষগুলোর বিপদই বোধহয় সাহস জুগিয়েছিল মহাশ্বেতাদের।
আরও শুনুন: রুশ কবল থেকে বাঁচাতে হবে শহর! ব্যস্ত হাতে ব্যারিকেড গড়ছে একদল খুদে
আসলে এ ভাবেই তো একের পর এক পাহাড় ভাঙে। যেমন ভেঙেছেন এই বাঙালি কন্যা। বিপদ মাথায় করে তিনি উদ্ধার করে এনেছেন সাত হাজারেরও বেশি ভারতীয়কে। বঙ্গকন্যার এই সাফল্যকে কুর্নিশ জানিয়েছে গোটা বিশ্ব।