মেয়েদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে খোদ উত্তরপ্রদেশের মহিলা কমিশন রাজ্য সরকারের কাছে এমনই কতকগুলি প্রস্তাব পেশ করেছেন। যা নিয়ে ঘনিয়ে উঠেছে বিতর্ক। নারীর চারপাশের সুরক্ষা বলয়ের জন্য পুরুষকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়ার বিষয়টি একদিকে পুরুষের জন্য যেমন সম্মানজনক নয়, তেমনই নারীর জন্যেও তীব্র অবমাননাকর।পুরুষবিহীন একটি দৃষ্টিভঙ্গিই কি হয়ে উঠবে নিরাপত্তার দেওয়াল?
এবার থেকে মহিলাদের জামাকাপড়ের মাপ নেওয়ার সময় উপস্থিত থাকতে পারবেন না কোনও পুরুষ দর্জি। সেলুন অথবা পার্লারে কোনও পুরুষ কর্মী কাটতে পারবেন না মহিলাদের মাথার চুল। এখানেই শেষ নয়। ছেলে এবং মেয়েদের জিম হবে আলাদা। মহিলাদের জিমে থাকতে পারবেন না কোনও পুরুষ ট্রেনার। কী, শুনে অবাক হচ্ছেন তো? না, এটা বিগত শতাব্দীর সময়ের কথা নয়। মেয়েদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে খোদ উত্তরপ্রদেশের মহিলা কমিশন রাজ্য সরকারের কাছে এমনই কতকগুলি প্রস্তাব পেশ করেছেন। যা নিয়ে ঘনিয়ে উঠেছে বিতর্ক।
আরও শুনুন: স্বাধীনতা চেয়ে যে প্রতিবাদ, তার ভাষাও হোক স্বাধীন
দেশজুড়ে মেয়েদের সুরক্ষা নিয়ে নানা প্রশ্ন। অফিস থেকে বাজারে, এমনকী বাড়িতেও– কতটা সুরক্ষিত মেয়েরা? সম্প্রতি সেই প্রশ্নে নতুন বিতর্ক উসকে দিল উত্তরপ্রদেশের মহিলা কমিশনের দেওয়া ওই প্রস্তাবগুলি। সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ২৮ অক্টোবর মহিলাদের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা নিয়ে রাজ্য মহিলা কমিশনের একটি বৈঠক হয়। আর সেখানেই এই প্রস্তাব পেশ করা হয়। আর এতকিছুর পিছনে কমিশনের যুক্তি একেবারে অকাট্য। দিনের পর দিন মহিলাদের সঙ্গে ঘটে চলা নানান অবমাননাকর ঘটনা থেকে তাঁদের সুরক্ষা দেওয়া। দর্জির দোকান, সেলুন ও পার্লার এবং জিম– এই পেশাগুলোর সুযোগ নিয়েই নাকি মেয়েদের প্রতি অশালীন আচরণ করার সুযোগ নেন পুরুষরা। তাই রাজ্য সরকারের কাছে এই আবেদন পাঠিয়ে, মেয়েদের সুরক্ষার জন্য ওই পেশাগুলি থেকে পুরুষদের আলাদা করে পুরো বিষয়টিকে আইনের আওতায় আনারই প্রস্তাব করেছে উত্তরপ্রদেশ মহিলা কমিশন।
আরও শুনুন: ঘরের কাজ শুধু মেয়েদের! হাসতে হাসতেই পুরুষদের শিক্ষা দিলেন সুধা মূর্তি
মহিলা কমিশনের এহেন প্রস্তাবের পিছনে যুক্তি রয়েছে বইকি! কিন্তু পেশার সুযোগ নিয়ে মেয়েদের প্রতি অশালীন আচরণ বন্ধ করবার এই উদ্যোগ কি শুধুই নারীসুরক্ষার জন্যই, নাকি এমন ব্যবস্থার পিছনে রয়েছে নারী-পুরুষ বিভাজনের রাজনীতি? একবিংশ শতাব্দীর আধুনিকতার প্রেক্ষিতে এমন প্রশ্ন ওঠা খুব স্বাভাবিক। মেয়েদের হেনস্তা রুখতে গিয়ে উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকার কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বিভাজনকে একটি ব্যবস্থাতন্ত্রের রূপ দিতেই চাইছে না তো?
আর এখানেই খুব বড় একটি প্রশ্নচিহ্ন। নারীর চলাফেরা, কাজকর্মের সমস্ত পরিসর থেকে পুরুষকে বিয়োগ করতে পারলেই কি নারী সুরক্ষিত? অর্থাৎ নারী-সুরক্ষার জন্য আরও অস্যংখ্য পরিকাঠামো অথবা প্রযুক্তিকে পাশে ফেলে কেবল পুরুষবিহীন একটি দৃষ্টিভঙ্গিই কি হয়ে উঠবে নিরাপত্তার দেওয়াল?
পুরুষ-নারীর সমান অধিকারের কথা এই মুহূর্তে সমাজের অতি-আলোচিত বিষয়গুলির একটি। পিতৃতান্ত্রিকতার আধিপত্যের কবল থেকে মুক্তি পেতেই বিশ শতকের গোড়ার দিকে এসেছিল নারীবাদী তত্ত্ব। আর এই তত্ত্বের ইশতেহারটিই ছিল নারীর যৌন অধিকারকে কেন্দ্র করে। সেখানে যেমন ছিল নারীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমতার কথা, তেমনই ছিল নারীযৌনতার বিশেষ পাঠ। নারী তার নিজের অধিকার এবং নিরাপত্তার জন্য সমানাধিকারের লড়াই করবে। নারীকে অবদমিত করে রাখতেই তো পুরুষ তার মতো করে শাসনতন্ত্র তৈরি করেছে। পুরুষের সেই শাসনযন্ত্রে পিষ্ট হতে হতেই একদিন নারী ঘুরে দাঁড়িয়েছিল নারী-পুরুষের সমানাধিকার আদায়ের লড়াইয়ে। গত শতাব্দীর নারীবাদী আন্দোলনের ইতিহাস সেকথাই বলে। নারীবাদী আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস পেরিয়ে আজ যখন কর্মক্ষেত্রে নারীপুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে উত্তরপ্রদেশের মহিলা কমিশন নারী-সুরক্ষার যে প্রস্তাব এনেছে, তা আদতে কর্মক্ষেত্রে পুরুষের থেকে নারীকে বিভাজিত করার উদ্দেশ্য নয়তো? নারীর চারপাশের সুরক্ষা বলয়ের জন্য পুরুষকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়ার বিষয়টি একদিকে পুরুষের জন্য যেমন সম্মানজনক নয়, তেমনই নারীর জন্যেও তীব্র অবমাননাকর।
আরও শুনুন: ধর্ষিতাদের মুখ লুকোনোর দায় নেই, দেশজোড়া ‘গরিমা যাত্রা’য় হেঁটে বুঝিয়েছিলেন নির্যাতিতারা
নারী-সুরক্ষার ছুতোয় মেয়েদেরকে সব দিক থেকে পুরুষের থেকে আলাদা করার এই রাজনীতি যে যোগীরাজ্যের ঘোষিত নীতি, সাম্প্রতিক ইতিহাস তো সে কথাই প্রমাণ করে। ভ্যালেন্টাইন্স ডে বিরোধী প্রচার থেকে অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড গঠন– যোগীরাজ্যে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাই তো সেই বিভাজনের রাজনীতিকেই জোরাল করে। তাই বহিরঙ্গে আধুনিকতার চাকচিক্য রেখে কর্মক্ষেত্রে নারী-সুরক্ষার নামে পুরুষ বর্জনের বিভাজনের এই নীতি আসলে যে পিছন দিকে এগিয়ে চলা, এ নিয়ে বোধহয় সংশয় থাকার কথা নয়।