বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহরবাসীদের মধ্যে বেড়ে চলেছে ওবেসিটি। অল্পবয়সীরাও ভুগছেন হাই ব্লাড প্রেশার, সুগার নিয়ে। এমনকি ডায়বেটিসের মতো রোগ যা সাধারণত বয়সকালে হয়ে থাকে, তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কলেজপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও। আর এর মূল কারণ, ১০ মিনিটের ডেলিভারি সার্ভিস! সহজেই আনিয়ে নেওয়া যাচ্ছে নামী রেস্টুরেন্টের খাবার কিংবা প্যাকেটজাত ইন্সট্যান্ট নুডলস্। তাই ঘরের তৈরি খাবারের বদলে এসবের দিকে ঝুঁকছে জেন-জি।
ঘরে বসেই অনলাইন অ্যাপে অর্ডার দেওয়া যাচ্ছে যা ইচ্ছে তাই। বড়জোর মিনিট পনেরোর মধ্যে তা চলেও আসছে বাড়ির দরজায়। ক্রেতা সন্তুষ্ট হয়ে ভাবছেন, আগের থেকে কত সহজই না হয়ে গিয়েছে জীবনযাপন! অথচ আপাত সাধারণ এই কুইক কমার্স সার্ভিসের (Quick Commerce) পিছনে রয়েছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। নিয়মিত অনলাইন ডেলিভারি চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে দিয়ে যেন জন্ম নিচ্ছে জটিল সামাজিক ব্যাধি, যার শেষ কোথায়, তা এখনও জানা নেই কারও।
যে কোনও ধরনের কুইক কমার্স সার্ভিস যে সেটির সঙ্গে সংযুক্ত কর্মচারীদের পক্ষে খুব একটা সুখকর হয় না, তা বলাই বাহুল্য। কাজের অনিশ্চয়তা হোক, বা দ্রুত জিনিস পৌঁছে দেওয়ার ফলে প্রাণহানির আশঙ্কা, গিগকর্মীরা এ নিয়ে বারে বারেই সরব হয়েছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে যে বিষয়টি একেবারেই অনালোচিত রয়ে যায়, তা হল এ ধরনের পরিষেবা গ্রহণকারী ক্রেতাদের কথা। একটা সময় ছিল যখন কী কী কিনতে হবে, তা আগে ফর্দ করে লিখতে বসত সাধারণ মানুষ। তারপর সে ফর্দ হাতে দোকানে যেত। সেখানে কেবল জিনিস নয়, প্রায়শই দোকানির সঙ্গে ক্রেতার এক মানবিক সম্পর্ক গড়ে উঠত। হয়তো প্রিয় ক্রেতার জন্য কখনও বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করে দিতেন দোকানি, অথবা দোকানে আসা নতুন কোনও জিনিস বিনামূল্যেই গুঁজে দিতেন বাজারের ব্যাগে।
২০১৯ সালের শেষদিকে ভারতবর্ষে অনলাইন ডেলিভারি অ্যাপের ভালোমতো চল শুরু হয়ে গিয়ে থাকলেও, কোভিডকালেই তার সবচাইতে বেশি বাড়বাড়ন্ত দেখা যায়। আর এরপর বাজারে আসে কুইক কমার্স সার্ভিস (Quick Commerce), যারা মাত্র ১০-১৫ মিনিটেই প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস হাজির করে ক্রেতার দোরগোড়ায়। স্বাভাবিক ভাবেই, প্রাথমিক অবস্থায় এ নিয়ে সাধারণ মানুষের ছুৎমার্গ থাকলেও, জলদিই তা উবে যায়। বরং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন যত বাড়তে থাকতে, ততই যেন জীবনের গতি দ্রুত হতে থাকে সাধারণ মানুষের। আর দোকান ঘুরে ঘুরে জিনিস কেনার চাইতে, ঘরে বসেই যা কিছু দরকার তা আনিয়ে নেওয়াকে সহজ বলে ঠাওর হয় বেশিরভাগ ক্রেতার। সেখান থেকেই সূত্রপাত হয় সমস্যারও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহরবাসীদের মধ্যে বেড়ে চলেছে ওবেসিটি। অল্পবয়সীরাও ভুগছেন হাই ব্লাড প্রেশার, সুগার নিয়ে। এমনকি ডায়বেটিসের মতো রোগ যা সাধারণত বয়সকালে হয়ে থাকে, তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কলেজপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও। আর এর মূল কারণ, ১০ মিনিটের ডেলিভারি সার্ভিস! সহজেই আনিয়ে নেওয়া যাচ্ছে নামী রেস্টুরেন্টের খাবার কিংবা প্যাকেটজাত ইন্সট্যান্ট নুডলস্। তাই ঘরের তৈরি খাবারের বদলে এসবের দিকে ঝুঁকছে জেন-জি। পাশাপাশি, বাড়ি থেকে বেরোনোও কমে যাচ্ছে তাদের। যে প্রজন্মের মানসিক অবসাদ বা মনোরোগ রীতিমতো আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, কুইক কমার্স সার্ভিস তাদেরকেই আরও বেশি করে বেঁধে ফেলছে ঘরের চৌহদ্দির মধ্যে। সমীক্ষা বলছে, যেসব গ্রামীণ এলাকায় এখনও এ ধরণের পরিষেবা চালু হয়নি, সেখানে নাকি এ ধরনের শারীরিক ও মানসিক রোগের মাত্রা চোখে পড়ার মতো কম।
ডেলিভারি অ্যাপগুলো সময় বেঁধে দেয় বলেই, উত্তোরত্তর অধৈর্য হয়ে পড়ছে তরুণ প্রজন্ম। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলে অস্থির হয়ে পড়ছে তারা। আর এর প্রতিফলন পড়ছে তাদের ব্যক্তিগত জীবনেও। সমীক্ষা জানাচ্ছে, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটার ক্ষেত্রে দোকানে যাওয়ার চাইতে বাড়ি বসে অর্ডার করে দেওয়াই পছন্দ করে তরুণ প্রজন্ম। কারণ এই উপায়ে সামাজিকতা এড়িয়ে যাওয়া যায়! তাদের বক্তব্য শুনলেই বোঝা যায় যে, সামাজিকতার মতো সহজ মানবিক সম্পর্ককেও কি সহজে বাড়তি বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে বর্তমান দ্রুততার যুগে। আরও কোনঠাসা করে দেওয়া হচ্ছে ছেলেমেয়েদের, সমাজচ্যুত বিচ্ছিন্ন জীব হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে।
অর্থাৎ যে কাজ দশ মিনিটে সেরে তরুণ প্রজন্ম মনে করছে অনেকখানি শ্রম বাঁচান গেল, তারা জানতেও পারছে না যে এর খেসারত আগামীদিনে দিতে হবে তাদেরকেই। আর তার মূল্য হবে এর চাইতে অনেক, অনেক বেশি। বর্তমানে বেড়ে চলা মানসিক সমস্যা থেকে বাঁচতে হাজারও উপায় বাতলাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। অথচ সাধারণ মানুষ নিজেদেরই অজান্তে দশ মিনিটেই সে রোগব্যাধি আনিয়ে নিচ্ছে বাড়ির দরজায়!