চল্লিশেও সিঙ্গল! তা-ও আবার কোনও মেয়ে! ভেবে কেউ নাক কুঁচকোতে পারেন। কিন্তু সামাজিক সেই ভুরু কোঁচকানিকে আর পরোয়াই করছেন না ভারতীয় মহিলারা। বরং বয়স যা-ই হোক না কেন, সিঙ্গল থেকে যদি সুখ ও স্বস্তি পাওয়া যায়, তবে একলা থাকতে দ্বিধা করছেন না তাঁরা। কোন মন্ত্রবলে এই একা থাকার সাহস অর্জন করছেন তাঁরা? আসুন শুনেই নেওয়া যাক।
ছেলেদের ক্ষেত্রে সেভাবে কেউ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় না, কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে তা সকলেই দেখিয়ে দিতে তৈরি। তা হল, বিয়ের বয়স। সমাজের অলিখিত সংবিধান ঠিক বুঝিয়ে দেয় কোন বয়সের পর মহিলাদের সিঙ্গল থাকা বা বিয়ে না-কর রীতিমতো গর্হিত কাজ। এক কি দেড় দশক আগেও এই পিঞ্জর থেকে সেভাবে বেরিয়ে আসতে পারতেন না নারীরা। বয়সের একটা করে চৌকাঠ পেরোতে পেরোতে তাঁরাও ভাবতেন, বিয়ে-থা করে সংসারটা এবার করে ফেলাটাই দস্তুর। কিন্তু সময় বদলেছে। বর্তমানে আর লোকে কী ভাববে তা ভেবে বিয়ের কথা ভাবছেন না ভারতীয় নারীরা। বরং বয়স যা-ই হোক না কেন, বিয়ের থেকে সুখে ও স্বস্তিতে থাকাকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন তাঁরা। তাতে যদি বিয়ে না হয়, যদি একা থাকতে হয়, তা-ও কুছ পরোয়া নেই।
আরও শুনুন: দেশে প্রথম সমকামী বিয়ের বিজ্ঞাপন দেন তিনিই, সন্তানের জন্য ছক ভেঙেছিলেন এই মা
এই প্রবণতাকে একটু অন্যভাবেই দেখছে বর্তমান সমাজব্যবস্থা। প্রশ্ন উঠছে, কেন বিয়েতে এখন মেয়েদের অনীহা? মহিলারা অবশ্য প্রশ্নটিকে আর-একটু অন্যরকম ভাবে ঘুরিয়ে দেখতেই পছন্দ করছেন। তাঁরা বলছেন, প্রশ্নটা বরং এরকম হোক যে, কেন বিয়ের থেকেও একা থাকাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও একই সঙ্গে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করছেন বর্তমান মেয়েরা? তবে প্রশ্ন যা-ই হোক না কেন, উত্তরের অভিমুখ সব একই দিকে। এ পর্যন্ত সামাজিক নানা প্রত্যাশাই পূরণ করে গিয়েছেন নারীরা। বিয়ে যত না ভালবাসার সংগঠন তার থেকেও বেশি সামাজিক চুক্তিপত্র হয়েই ধরা দিয়েছে। তাই বলে কি বিবাহিত দম্পতির মধ্যে প্রেম-প্রণয় ঘনিয়ে ওঠেনি? নিশ্চয়ই তা হয়েছে। এইভাবেই চলতি হাওয়ার পন্থী হয়ে বহু সম্পর্কই অমরপ্রেমের আস্বাদ পেয়েছে। আবার বৈবাহিক সম্পর্ক তিক্ত হয়েছে এমন উদাহরণও আছে যথেষ্ট। সেই তিক্ততা বয়ে বেড়িয়েছেন নারীরা আজীবন। বুক ফেটেছে তবু মুখ ফুটে কিছু বলেননি। কেন-না ওই যে সামাজিক জাঁতাকল, যা তাঁদের তেমন করে কিছু বলতে দেয়নি। এর একটা বড় কারণ অর্থনৈতিক পরাধীনতা। যতদিন মেয়েরা উপার্জনক্ষম ছিলেন না, ততদিন ব্যক্তিগত কামনা-বাসনা, চাওয়া-পাওয়াগুলিকে তাঁরা সিন্দুকেই তুলে রেখেছিলেন, উপায় ছিল না বলে। এই গড় পরিস্থিতি থেকে কয়েকজনই হয়তো বেরিয়ে আসতে পারতেন সেকালে। তাঁরা সমাজের মূলস্রোত কখনোই নয়, ব্যতিক্রমী বলে চিহ্নিত হতেন।
আরও শুনুন: চাকরি না করেও কোটিপতি! চমক লাগায় এই মহিলা ইউটিউবারদের সম্পত্তির পরিমাণ
সময় যত বদলেছে, তত এই পরিস্থিতি পালটে গিয়েছে। সামাজিক প্রত্যাশার কাছে নতিস্বীকার করে চুপ করে থেকে যাওয়া প্রজন্ম এখন অতীত। পড়াশোনার হার বাড়ার দরুন চাকরিক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণ-ও বেড়েছে। এখান থেকেই মূল বদলের সূত্রপাত। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মহিলাদের চিন্তাভাবনার স্বাধীনতাও দিয়েছিল যথেষ্ট। ফলত সম্পর্ক, বিয়ে ইত্যাদি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বা কথা বলার জোর তাঁরা পেয়েছেন বহুদিন। এই অবস্থায় আরও অনেকটাই সময় বয়ে গিয়েছে। ফলে এখন মহিলারা আর সামাজিক প্রত্যাশা বা কে কী ভাববে ইত্যাদি বিষয়কে তেমন গুরুত্বই দিচ্ছেন না। বরং সবার আগে নিজেকে ভাল রাখা যে জরুরি, সে বিষয়টিকেই শিরোধার্য করছেন। বিয়ের ভাল দিক যেমন অনেক আছে, মন্দ দিক তেমনই। আর তাই মন্দের ভালোকে মেনে না নিয়ে, একা একা ভাল থাকা অনেক বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে বর্তমান সময়ের মেয়েদের কাছে।
কিন্তু তাতে কি সামাজিক চাপ উবে গিয়েছে? একেবারেই না। তবে নানা সমঝোতা করতে করতে, নানা যুদ্ধ যুঝতে যুঝতে মেয়েরা এখন এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছেন যেখানে, তাঁরা যেটা চাইছেন সেটা করতে পারেন। এমন নয় যে, তাঁরা বিয়ে-বিমুখ। কিন্তু যখন একটা সম্পর্ক থেকে যথেষ্ট পারস্পরিক নির্ভরতার আশ্বাস মিলবে, যখন সঙ্গীর থেকে সেই আশ্বাস মিলবে, তখনই তাঁরা বিয়ের মতো সামাজিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়বেন, অন্যথায় নয়। চল্লিশ পেরিয়েও যাঁরা সিঙ্গল, এমন বহু মহিলা মনে করছেন এমনটাই। অনেকে আবার সম্পর্কে থেকে যে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন সেই জায়গা থেকেই আর নতুন কোনও সম্পর্কে জড়াতে নারাজ। অর্থাৎ কোনও শর্ত নয়, নিজের জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতাকে পূর্ণ মাত্রাতেই অনুভব করতে চাইছেন আজকের নারীরা। আর তাই, মেয়েদের সম্পর্কিত গোড়ার প্রশ্নটি কেবলমাত্র মেয়েদের নয়। বরং তা বর্তমান সমাজের পরিবর্তনমুখর বাস্তবতাটির দিকেই ইঙ্গিত করছে। যা আসলে সমাজের অন্তর্গত ব্যবস্থার ভিতরেই নয়া বদলের আভাস। সিঙ্গল মেয়েদের নিয়ে লোকে কী ভাববে, তা না ভেবে বরং ভাবা দরকার সেই পরিবর্তন সম্ভাবনা নিয়েই।