নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে নিতে রাষ্ট্রের সেনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ। আর সেই প্রতিবাদীদের মধ্যেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক বৃদ্ধা। সশস্ত্র সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে তিনিও শামিল রোজ। তিনি শ্রীলঙ্কার ‘জিন আন্টি’। যাঁকে দেখে মনে পড়ে যায় শাহিনবাগ আন্দোলনের সেই বিখ্যাত ‘দাদি’-র কথা। হ্যাঁ, সেই বিলকিস বেগমের মতোই, বয়সের কাছে হার মানেনি শ্রীলঙ্কার এই বৃদ্ধার প্রতিবাদও। মারের মুখের উপর দিয়েই এগিয়ে চলার ব্রত নিয়েছেন তাঁরা। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
কয়েক মাস ধরেই বিক্ষোভে পুড়ছে দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। মুখ থুবড়ে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। তুঙ্গে উঠেছে জ্বালানি এবং খাদ্য সংকট। অযোগ্য শাসককে সরানোর দাবিতে রাজপথে নেমে এসেছেন তারকা ক্রিকেটার থেকে আমজনতা সকলেই। এই গণঅভ্যুত্থানের মুখ পড়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। এমনকি নয়া প্রেসিডেন্ট হিসেবে রনিল বিক্রমসিংহ মসনদে বসার পরেও অব্যাহত গণবিক্ষোভ। আর সেই প্রতিবাদী জনতার দলেই নজর কেড়েছেন এক নারী। অবশ্য তাঁকে বৃদ্ধা বলাই সংগত। যদিও নিজের বয়স প্রকাশ্যে আনতে ঘোরতর আপত্তি রয়েছে তাঁর। কিন্তু তিনি যে ১৩ জনের ঠাকুমা এবং দুজনের প্রপিতামহীও, সে কথা অবশ্য সগর্বেই স্বীকার করেন জঁ প্রিমরোজ নাথানিয়েলজ, ওরফে সকলের প্রিয় ‘জিন আন্টি’। প্রতিদিন ট্রেনে চেপে, মানুষের উপচে পড়া ভিড় ঠেলে কলম্বোর গল ফেসে প্রতিবাদীদের আস্তানায় এসে হাজির হন এই বৃদ্ধা। তাঁর মতে, তিনি যদি এই বয়সেও দেশের জন্য এগিয়ে আসতে পারেন, তাহলে দেশের তরুণ-তরুণীরা পিছিয়ে থাকবে কেন!
আরও শুনুন: করতেন জুতো সারাই, তাঁকেও অতিথি হিসাবে ডাক পাঠিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি কালাম
এদিকে ক্ষমতায় এসেই সেনাবাহিনীকে কঠোর হাতে বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দিয়েছেন নয়া প্রেসিডেন্ট। তাঁর হুকুমেই কলম্বোয় আন্দোলনকারীদের ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দিয়েছে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী। অবস্থানকারীদের ব্যারিকেড ভেঙে, তাদের তাঁবুগুলি উপড়ে ফেলে দিয়েছে সেনা। আর এই ঘটনাকে মোটেও ভাল চোখে দেখেননি জিন আন্টি। দেখা গিয়েছে, সশস্ত্র সেনা এবং পরে সাংবাদিকদের সামনেও এই হামলার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তাঁর সাফ কথা, আন্দোলনকারীদের হাতে একটা নুড়ি পর্যন্ত নেই। নিরস্ত্র মানুষদের এভাবে হেনস্তা করা হলে রাগ হওয়া তো অনিবার্য।
আরও শুনুন: হারিয়েছেন স্বামীকে, অকালমৃত্যু দুই সন্তানের… শোকের ঝড় পেরিয়ে রাইসিনা হিলসে দ্রৌপদী মুর্মু
জিন আন্টি মনে করিয়ে দিচ্ছেন দিল্লির শাহিনবাগ আন্দোলনের সময়কার সেই বিলকিস বেগমের কথা, গোটা দেশ যাঁকে চিনেছিল ‘দাদি’ বলেই। নিজের ঘরসংসার ছেড়ে, দিল্লির ঠান্ডায় দিনের পর দিন অন্য অবস্থানকারীদের সঙ্গে রাজপথে বসে ছিলেন বিলকিস। দীর্ঘ আড়াই মাস ধরে শাহিনবাগে অবস্থান বিক্ষোভে শামিল হওয়া মহিলাদের মুখ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। পরে কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে দিল্লিতে যখন আন্দোলন শুরু করেন কৃষকেরা, তখনও তাঁদের পাশে দাঁড়াতে ছুটে গিয়েছিলেন ৮৩ বছরের বিলকিস। যেমনভাবে বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন জিন আন্টিও। তাঁর টিশার্টের একদিকে লেখা থাকে ‘আরাগালায়’ অর্থাৎ সংগ্রাম, আর অন্যদিকে লেখা থাকে ‘স্বাধীনতার জন্য আমাদের লড়াই’। দুবার সেনার টিয়ার গ্যাসের মুখে পড়েছেন তিনি। যার জেরে চোখে যন্ত্রণা হয় এখনও। তবুও লড়াইয়ের ময়দান ছাড়তে নারাজ এই বৃদ্ধা। এ লড়াই আসলে মানুষের অধিকারের জন্য, তাই পিছু হটার কোনও প্রশ্নই নেই- এমনটাই জানান জিন আন্টি।
বয়স কিংবা শারীরিক সক্ষমতা নয়, প্রতিবাদ তো আসলে এক চেতনা। যে নির্ভর করে মনের জোরের উপরেই। দেশকালের সীমানা পেরিয়ে তাই বিলকিস দাদি কিংবা জিন আন্টিরা বুঝিয়ে দিয়ে যান, শাসকের আস্ফালন যেমন বারবার আক্রমণ শানাবে, তেমনই চিরন্তন হয়ে থাকবে সাধারণের প্রতিস্পর্ধাও।