এ দেশে কলেজ থেকে, কাজ থেকে, সিনেমা দেখে, পার্টি করে ফেরার পথে মেয়েদের আর ফেরা হয় না। কামদুনি, আর জি কর, হায়দরাবাদ, দিল্লি, পার্ক স্ট্রিট, একের পর এক নাম বিচারের দরবারে জমা হতে থাকে। সেইসব নামের সামনে দাঁড়িয়ে এক খুদে বলে উঠেছে, ‘আই ওয়ান্ট জাস্টিস’।
সবাই দেখছে, রাজা উলঙ্গ। তবুও সবাই হাততালি দিচ্ছে। বাহবায় মুখরিত হচ্ছে চারপাশ। কেন-না কারও সত্যিটা বলার সাহস নেই। সেই সময়েই এক শিশুর প্রশ্নে কাচের দেওয়াল ভেঙে যায়- “রাজা, তোর কাপড় কোথায়?”
আমরাও জানি, আমাদের গোটা দুনিয়াটা আপাতত তেমনই এক মিথ্যের বেসাতি। অথচ, সে কথা কারও বলার ক্ষমতা নেই। কারও ভয়, কারও লোভ, কারও সংশয় সত্যি বলতে বাধা দেয়। তাই নিজের মনকে চোখ ঠেরে চলা ছাড়া আর গতি কী! যেমনটা চলছে, তেমনটাতেই কোনও মতে সামলেসুমলে নিয়ে থেকে যাওয়ার চেষ্টা চলে। সমাজের প্রতি একজন বুদ্ধিজীবীর কী দায় তা বোঝাতে গিয়ে এডওয়ার্ড সাইদ লিখেছিলেন, জনগণের মাঝে তাঁর ভূমিকা আগন্তুকের, ‘যা-চলছে-চলুক’ এই স্থিতাবস্থায় যিনি বিঘ্ন ঘটান। এই আগন্তুক আসলে যে কেউ হতে পারেন। তবে তাঁর অন্তরে থেকে যেতে হবে ওই ছোট্ট শিশুটিকেই, যে সবার সামনে প্রশ্ন তুলতে পারে।
আরও শুনুন:
নির্যাতনের দামে কেনা, তাই খোলা আকাশের অধিকার মেয়েদেরও
মধ্যরাতের বাংলা এবার দেখল তেমনই মুখ। যে মুখ নেহাতই কচি মেয়ের গলায় বলে উঠেছে, আই ওয়ান্ট জাস্টিস। আমি ন্যায়বিচার চাই। সে জানে না, এ দেশে ন্যায়বিচার সুলভ নয়। এ দেশে মেয়েরা দিনের পর দিন পথে বসে জানান দেন, তাঁদের শরীরে জোর করে হাত ছুঁইয়েছে কেউ, তার বিচার হোক। বিচার মেলে না। এ দেশে কলেজ থেকে, কাজ থেকে, সিনেমা দেখে, পার্টি করে ফেরার পথে মেয়েদের আর ফেরা হয় না। কামদুনি, আর জি কর, হায়দরাবাদ, দিল্লি, পার্ক স্ট্রিট, একের পর এক নাম বিচারের দরবারে জমা হতে থাকে। সেইসব নামের সামনে দাঁড়িয়ে এক খুদে বলে উঠেছে, আই ওয়ান্ট জাস্টিস। তার পিছনে ঘন কালো রাতের যবনিকা। সেই রাত, যে রাত ভয়ের। যে রাত পীড়নের। যে রাতে সবসময়, সব মেয়েরা বিপন্ন। নারীশরীর লঙ্ঘিত হলে বারবার রাত্রিকে ঢাল বানানো হয়। সেই রাত দখলের ডাকেই এবার পথে নেমেছিলেন মেয়েরা। প্রশ্ন তুলেছিলেন, রাতের মধ্যে তো কোনও অসুন্দর নেই। তাহলে কেন যাবতীয় অসুন্দরের জন্য রাতের পরিসরকে ছেড়ে দিতে হবে? কেন ধর্ষক, হত্যাকারী, নির্যাতকের দখলে যাবে রাত; আর কেন মেয়েদের থেকে কেড়ে নেওয়া হবে রাতের মালিকানা? আসলে তো এই এক রাতের ডাকে শামিল হওয়ার পেছনে অনেক রাতের ভয়ের অধ্যায় রয়ে গিয়েছে। যেসব রাতে বিপন্নতার সামনে গুটিয়ে যেতে যেতে নিজের যাবতীয় যুক্তি তর্ক ভাবনা চেতনাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হয়েছে। কারণ আশেপাশের সবাই তখন গভীর ঘুমে। বিপুল দাঁত নখের সামনে একা দাঁড়ানো যায়নি তাই। কিংবা ডেকেও ঘুম ভাঙেনি কারও। তাই সেই গহিন রাতেই ঢেকে গিয়েছে ন্যায়বিচারের দাবি। সেই সমস্ত রাত এবার জেগে উঠেছে। মনে করিয়ে দিচ্ছে, বিপন্নতার সামনে জেগে থাকাটাই একটা ধর্ম। আর সেই জেগে থাকার দায় কারও একার নয়, সক্কলের। সেই জাগরণের স্বর হয়ে উঠে আসছে এক কচি গলা- ‘আই ওয়ান্ট জাস্টিস’।
কী, কেন, কবে- এসব কথা নতুন করে বলা এখন বাহুল্য। কর্মক্ষেত্রের নিশ্চিন্ত পরিসরেই এক মেয়েকে যে মরে যেতে হল, মরে যেতে হল তীব্র তীক্ষ্ণ নির্যাতনের যন্ত্রণা নিয়ে, এ লজ্জা পুরুষের এতদিনের নিশ্চিন্ত ঘুমে তীক্ষ্ণ হয়ে বিঁধে গিয়েছে। এই নির্যাতন মেয়েদের সামগ্রিক বিপন্নতাকে জাগিয়ে দিয়েছে। সেখান থেকেই জেগে ওঠার ডাক এসেছে। রাজ্য জুড়ে দুশোর বেশি জায়গায় পথে নেমেছেন মেয়েরা। সেই রাত্রিবেলায়, যে রাতে পথে নামলেই ‘খারাপ মেয়ে’ হয়ে যেতে হয়। না, একটিমাত্র রাতের পথে নামা সব রাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না। কাম্যুর ‘প্লেগ’-এর কথা মনে পড়ে, যেখানে রিউ জানত প্লেগের বিরুদ্ধে আপাত জয়টুকুও বড় সাময়িক। আমাদের গোটা দুনিয়াতে যে পচন ধরেছে, যেখানে বোধ আর মূল্যবোধ খসে পড়ছে রোজ, তা তো সেই প্লেগের মতোই এক অতিমারি। তার সামনে লড়াই কোনও গন্তব্যে পৌঁছবে কি না জানা নেই, তবুও সমস্ত বধিরতার সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে যেতে হবে- ‘আই ওয়ান্ট জাস্টিস’। মেয়েদের রাত দখলের লড়াইয়ে এই স্বর তুলে এনে যেন ঈশ্বরিত হয়ে উঠল হলুদ জামার সে খুদে মেয়ের মুখ। ভিড়ের মধ্যে থেকে জেগে উঠল এক খুদের হাতে ধরা পোস্টার- ‘আমি ভয় ছাড়া বড় হব’। কিংবা বছর পাঁচেকের আরেক মেয়ে, যার প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘ছিঃ’ সপাটে চড় কষাল পচে-গলে যাওয়া যাবতীয় চিন্তাভাবনার মুখে।
আরও শুনুন:
আঁচল সরলেই ‘মন্দ মেয়ে’র উপাখ্যান! যেন প্রাচীন মুদ্রাদোষ
মেয়েকে তার ইচ্ছেয় চলতে দেওয়া যাবে না, তার ইচ্ছেয় বলতে দেওয়া যাবে না, ওদের পূর্বনারীদের সামনে কাঁটার বেড়া উঁচিয়ে রেখেছিল এমন সব অনুশাসন। সেও তো একরকমের মৌলবাদ। আর মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই সহজ নয়। তবুও মনে পড়ে সিডনি স্মিথের সেই কথা- “It is the greatest of all mistakes to do nothing because you can only do little – do what you can.” কিচ্ছু না করার সামনে সেই একটুখানি পারা নিয়েই প্রতিরোধ গড়ছে এই খুদেরা। তাদের মিছিলকে থামিয়ে দেবে, সাধ্য কার!