ঘরে বাইরে, যে কোনও জায়গায়, ধর্ষণের হাত থেকে মেয়েকে নিরাপত্তা দেবে কে? মেয়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাই নিজের হাতেই তুলে নিয়েছেন বাবা। মেয়ের মাথাতেই লাগিয়ে দিয়েছেন সিসিটিভি। এহেন পদক্ষেপ আশ্চর্য করে তো বটেই, পাশাপাশি আরও কিছু প্রশ্নও তুলে দেয়। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
রাস্তায় এদিক ওদিক থেকে উড়ে আসা নোংরা কথা। ট্রেনে বাসে শরীর ছুঁয়ে যাওয়া লোভী হাত। কাজের জায়গাতেও রেহাই নেই, সেখানেও যৌন হেনস্তার মুখে পড়তে হতে পারে যে কোনও মেয়েকে। এমনকি ধর্ষিতা হয়ে যেতেও পারেন যে কেউ। শুধু কি বাইরের দুনিয়াতেই এই অবস্থা? সমীক্ষা বলে, অধিকাংশ মেয়ে যৌন হেনস্তার তিক্ত অভিজ্ঞতা প্রথম পান বাড়ির ভিতরেই, চেনাজানা কোনও আত্মীয়ের হাতে। এহেন ধর্ষণ সংস্কৃতি যখন গোটা সমাজ জুড়েই রমরমিয়ে চলছে, মেয়েদের সেখানে নিরাপত্তা মিলবে কীভাবে? সাম্প্রতিক কালে একটি নারকীয় ধর্ষণের প্রেক্ষিতে যেমন সে প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে সর্বত্র। নতুন করে প্রশ্ন তুলছে, মেয়েদের সুরক্ষা দেবে কে? আর সেই আবহেই সামনে এল আশ্চর্য এক ঘটনা। যেখানে মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে তার মাথার উপরেই আস্ত সিসিটিভি বসিয়ে দিয়েছেন তার বাবা।
আরও শুনুন:
নির্যাতনের দামে কেনা, তাই খোলা আকাশের অধিকার মেয়েদেরও
যৌন হেনস্তা রুখতে সিসিটিভি লাগানোর কথা এমনিতেই সবসময়ে বলা হয়। রাস্তায়, স্টেশনে, যে কোনও পাবলিক প্লেসেই সিসিটিভি লাগানোর কথা, যাতে অপরাধমূলক ঘটনায় রাশ টানা যায়। কর্মক্ষেত্রেও যৌন হেনস্তা রোখার জন্য সিসিটিভি নজরদারির নিয়ম রয়েছে। কিন্তু তারপরেও তো ধর্ষণের প্রবণতা কমার নাম নেই। তাই বাইরের সিসিটিভির উপর ভরসা না করে একেবারে মেয়ের মাথার উপরেই সিসিটিভি লাগিয়ে দিয়েছেন ওই ব্যক্তি। যাতে মেয়ে কোথায় যাচ্ছে, তার সঙ্গে কথা বলছে কারা, কাদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, সবকিছুই নজরে থাকে। সেক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র বিপদের আঁচ পেলেই সুরক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, আশা পাকিস্তানের ওই ব্যক্তির। সম্প্রতি করাচিতে নৃশংস অত্যাচারে প্রাণ হারিয়েছেন এক নারী, তারপরেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে এই পদক্ষেপ করেছেন তিনি।
আরও শুনুন:
যৌন হেনস্তার শিকার প্রায় সকলেই! কত বয়সে? ভয়াবহ অভিজ্ঞতা উঠে আসছে সোশাল মিডিয়ায়
তবে এ ঘটনার সাপেক্ষে আরও কিছু কথা থেকেই যায়। এহেন পদক্ষেপ আশ্চর্য করে তো বটেই, যৌন হেনস্তার হার আমজনতাকে কী পরিমাণে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে তাও বুঝিয়ে দেয়। এ কথাও বুঝিয়ে দেয় যে নারীর সুরক্ষার প্রশ্নে প্রশাসন পুলিশ আইনকানুন কোনও কিছুর উপরেই আর ভরসা রাখতে পারছেন না তাঁরা। উলটোদিকে এ ঘটনা আরও কিছু প্রশ্নও তুলে দেয়। সেই প্রশ্নের মধ্যে সবার আগে এসে দাঁড়ায় মেয়েদের নিজের মতো বাঁচার অধিকার। আমরা জানি, ধর্ষণের সঙ্গে জুড়ে যায় ক্ষমতার বয়ান। নারীদেহ সম্ভোগের পাশাপাশি, নারীকে সবক শিখিয়ে দেওয়ার আগ্রহও ধর্ষণের নেপথ্যে থাকে। অর্থাৎ, নারী কেমন করে বাঁচবে তা ঠিক করে দিতে চায় ধর্ষক, নারীর চলা-বলা-চিন্তা-চেতনা পছন্দ না হলেই দমনের হাতিয়ার হিসেবে সে ধর্ষণকে ব্যবহার করতে চায়। এই মনোভাবের বিরুদ্ধেই তো সুর চড়াচ্ছেন মেয়েরা। সপাটে বলছেন, ‘হোয়ারএভার আই গো, হাওএভার আই ড্রেস, নো মিনস নো, ইয়েস মিনস ইয়েস।’ যৌন হেনস্তা বা ধর্ষণের ঘটনায় বারবার যেভাবে মেয়েকে বিঁধে প্রশ্ন করা হয়, সে কী পোশাক পরে ছিল, কেন ওই জায়গায় গিয়েছিল, সেইসব কারণেই তো হেনস্তা ঘটতে পারল- মেয়েরা সেই প্রশ্ন উড়িয়ে বলছেন, সবকিছুর পরেও সম্মতি ছাড়া কাউকে স্পর্শ করা যায় না। এবং ‘মাই বডি মাই চয়েস’ বলে তাঁরা স্পষ্টই বলছেন, সেই সম্মতি দেওয়ার অধিকারও তাঁদের। তাঁদের জীবন তাঁরা কীভাবে বাঁচবেন, তা ঠিক করবেন তাঁরা নিজেরাই। তাহলে ধর্ষণ রুখতে যদি সেই মেয়েদের উপরেই নজরদারি বাড়ানো হয়, তা মেয়েদের ওই নিজের জীবন নিজের মতো করে বাঁচার অধিকারকেই নাকচ করে। কারণ ওই নজরদারি তো প্রতি মুহূর্তে মেয়ের প্রতিটি গতিবিধিকে নজরে রাখছে, নিয়ন্ত্রণ করছে। তার জীবনের ব্যক্তিগত পরিসরকেই মর্যাদা দিচ্ছে না ওই নজরদারি। ধর্ষণ সংস্কৃতি কমছে না বলে যদি মেয়ের উপরেই নজরদারি বেড়ে চলে আরও, সে ঘটনা বিস্ময়ের নয়, বরং হতাশারই।