‘বেটিয়া’ মানেই ‘পরায়া ধন’! বংশের ধ্বজাধারী তাই কেবল ছেলেরাই। আজও সমাজের শিকড়ে গ্রথিত রয়েছে সেই বদ্ধমূল ধারণা। হাজার রকম প্রকল্প, আইন, প্রচার সত্ত্বেও তাই কন্যাভ্রূণ হত্যার মতো ঘটনায় রাশ টানা যায়নি। তাই আজও মাটির তলায় জ্যান্ত পুঁতে ফেলা হয় সদ্যোজাত কন্যাসন্তানটিকে। না, শুধু সিনেমা বা গল্পে নয়। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও তেমন ঘটনা আকছার ঘটে। কাটে না অন্ধকার। বদলায় না দেশ। আসুন, শুনে নেওয়া যাক সেই অন্ধকারের খতিয়ান।
লাঙলের আঘাতে জমি বিদীর্ণ করে এক ফুটফুটে কন্যাকে খুঁজে পেয়েছিলেন জনক। সীতা তাই ভূমিসুতা, আবার তিনি লক্ষ্মীও। কন্যা মানেই লক্ষ্মী। অথচ আজও অন্ধকার থেকে ধুকপুকে প্রাণকে তুলে আনতে হয় মাটি খুঁড়ে। জন্মের কিছুক্ষণের মধ্যেই যে লক্ষ্মীকে জ্যান্ত অবস্থাতে পুঁতে ফেলেছিল তাঁর নিজের পরিবার। চাষ করতে গিয়ে সেই সদ্যোজাতকে তুলে আনেন কৃষক। না, শুধু পুরাণে বা রামায়ণে নয়, এমন ঘটনা ঘটে আজও। সম্প্রতি তেমনই ঘটনা ঘটেছে গুজরাটের সবরকন্ঠ জেলার গামভোই গ্রামে।
আরও শুনুন: দলিতের হাতের রান্না মুখে তুলতে নারাজ, মিডডে মিল বয়কট করল পড়ুয়ারা
মাঠে চাষ করতে গিয়ে কানে ভেসে এসেছিল সদ্যোজাতের কান্নার শব্দ। খুব ক্ষীণ একটা শব্দের পিছু নিয়ে তিনি পৌঁছন সেই জায়গায়, যেখানে পুঁতে ফেলা হয়েছে জীবন্ত শিশুটিকে। মাটি খুঁড়ে সদ্যোজাত মেয়েটিকে কোলে তুলেই তিনি ছোটেন হাসপাতালে। চিকিৎসকেরা জানান, দীর্ঘক্ষণ মাটি চাপা থাকায় শ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছিল তার। শিশুটিকে অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শিশুটির মা-বাবার খোঁজে তল্লাশি শুরু করেছে পুলিশ। ৩০৭ ধারায় দায়ের হয়েছে একটি এফআইআরও।
আরও শুনুন: সুডৌল স্তন ছাড়া মিলবে না চাকরি, সংস্থার বিজ্ঞাপনে তুমুল বিতর্ক নেটদুনিয়ায়
না, এ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কিছু দিন আগেই মুক্তি পেয়েছে ‘জয়েশভাই জোরদার’ নামে একটি ছবি। কন্যাসন্তানের প্রতি অসাম্যের যে সামাজিক ব্যাধি আজও লাগাতার চলে আসছে, সেই ব্যাপারটিকে কৌতুকের মোড়কে তুলে ধরা হয়েছিল সিনেমায়। ‘বেটি বঁচাও বেটি পড়াও’-এর মতো অসংখ্য প্রকল্প, প্রচার অভিযান কোনও কিছুই সেই অন্ধকারে আলো জ্বালতে পারেনি। আজও শুধুমাত্র মেয়ে হয়ে জন্মানোর ‘অপরাধে’ প্রাণ হারাতে হয় অসংখ্য শিশুকে। ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথের সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, দেশে অন্তত ২ লক্ষ ৩৯ হাজার শিশুকন্যার মৃত্যু হয় জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যেই। আর তার কারণ অন্য কিছু নয়। শুধুমাত্র মেয়ে হয়ে জন্মানোটাই তাদের সবচেয়ে বড় ‘অপরাধ’। আজও দেশের বহু অংশেই মারাত্মক অবহেলার শিকার শিশুকন্যারা। জন্মানোর আগেই মেরে ফেলা হয় আজও অসংখ্য ভ্রূণকে। আজও দেশ জুড়ে গর্ভপাতের একটা প্রধান কারণ গর্ভে কন্যাভ্রূণ থাকা। হ্যাঁ, এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও ছবিটা বদলায়নি এতটুকুও। সৌভাগ্যবশত জন্মাতে পারলে বা টিকে থাকতে পারলেই যে রেহাই মিলবে তা কিন্তু নয়। আজও প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হয় অজস্র কিশোরী। পড়াশোনা তো দূরের, ন্যূনতম মানসিক বিকাশটুকু হওয়ার সুযোগ পর্যন্ত তারা পায় না। তার আগেই গর্ভে চলে আসে সন্তান। সামগ্রীক ভাবে গোটা জীবন জুড়েই আজও নানাবিধ বঞ্চনার শিকার হয়ে থাকেন মেয়েরা। যার শুরুটা সম্ভবত হয় তার নিজের পরিবারের হাত ধরেই। এমনকী হয়তো তা শুরু হয় গর্ভাবস্থায় থাকার সময় থেকেই। এই বিশ্বায়নের যুগে দাঁড়িয়েও আজও দেশ ডুবে রয়েছে সেই অন্ধকারে। কোথায় এর শেষ, সময় এগোলেও প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যায়।