লাপাতা হয়ে থাকা যাদের এতদিনের অভ্যাস ছিল, অথবা বলা যায় যে যাদের এতদিন লাপাতা করেই রাখা হয়েছিল, তারা এখন নিজেদের খুঁজে পেতে মরিয়া। নিজেদের হারিয়ে যাওয়া অধিকার ফিরে পেতে পথ হাঁটছে তারা। সেই মেয়েদের স্বরের নিশান হয়েই যেন এল এই খবর, যে- অস্কারে মনোনয়ন পেয়েছে ‘লাপাতা লেডিজ’ ছবিটি। মেয়েরা যে আর ‘লাপাতা’ থাকবে না, সে কথাই যেন ঘোষণা করল নারীর হাতে গড়া মেয়েদের কাহিনির অস্কারযাত্রা।
চিৎকার কর মেয়ে, দেখ কতদূর গলা যায়!
গলা পৌঁছে যাচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে। রাজপথ থেকে অলিগলি। সুপ্রিম কোর্ট থেকে অস্কারের বিশ্বমঞ্চ- দখল করছে মেয়েদের স্বর। লাপাতা হয়ে থাকা যাদের এতদিনের অভ্যাস ছিল, অথবা বলা যায় যে যাদের এতদিন লাপাতা করেই রাখা হয়েছিল, তারা এখন নিজেদের খুঁজে পেতে মরিয়া। আর সেই খোঁজের দায়িত্ব তারা তুলে নিয়েছে নিজেদের হাতেই। নিজেদের হারিয়ে যাওয়া অধিকার ফিরে পেতে পথ হাঁটছে তারা। সেই মেয়েদের স্বরের নিশান হয়েই যেন এল এই খবর, যে- অস্কারে মনোনয়ন পেয়েছে ‘লাপাতা লেডিজ’ ছবিটি। এক মহিলা পরিচালকের তৈরি ছবি, যে ছবি মেয়েদের নিজেকে খোঁজার কথাই বলে, নিজেদের অধিকার দখলের কথা বলে, দেশের অন্য সব ছবিকে পিছনে ফেলে ভারতের প্রতিনিধি হিসাবে এবার প্রথম মনোনয়ন পেল সেই ‘লাপাতা লেডিজ’।
২০২৫-এর অস্কার দৌড়ে নাম লিখিয়েছিল ২৯টি ছবি। তার মধ্যে ছিল ‘অ্যানিম্যাল’-এর মতো ছবি, যা নারীর প্রতি পুরুষের হেনস্তাকেও একরকম ভাবে মান্যতাই দিয়েছিল। বহু বিতর্ক সত্ত্বেও বক্স অফিসে বিপুল লাভ কুড়িয়ে নিতে তার বাধেনি। যে সমাজ মেয়েদের অধিকার নিয়ে আদৌ সচেতন নয়, নারীর হেনস্তাকেও সে অনেকসময় চিহ্নিতই করতে পারে না, সে কথাই স্পষ্ট করে দিয়েছিল ‘অ্যানিম্যাল’ বা ‘কবীর সিং’-এর মতো ছবিগুলি। আর এই উদগ্র পৌরুষের জয়গানের উলটো দিকে স্থির শান্ত প্রতিবাদের মতোই দাঁড়িয়ে ‘লাপাতা লেডিজ’, যা নারী ক্ষমতায়নের কথা বলে। ঘরে বা বাইরে নারীর প্রাপ্য অধিকারের কথা মনে করায়। একইসঙ্গে এ কথাও বুঝিয়ে দেয়, ‘ভালো মেয়ে’ বা ‘ভালো বউ’ হওয়ার লোভ দেখিয়ে কীভাবে নারীর অধিকারহীনতা বা অসম্মানকেই স্বীকৃতি দিয়ে চলেছে গোটা সমাজ। যাতে মেয়েরা ওই অধিকার না থাকাকে প্রশ্ন করতে না শেখে, তাই তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে নারীর নিজস্ব স্বর না থাকাই আসলে ভালো মেয়ের লক্ষণ।
:আরও শুনুন:
নির্যাতনের দামে কেনা, তাই খোলা আকাশের অধিকার মেয়েদেরও
এ কথা তো আমরা জানিই যে, মেয়েদের প্রশ্ন করাকে, যুক্তি চাওয়াকে কেউই ভালো চোখে দেখে না। কোনও একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মতোই, মেয়েদের নিজের মতো চলতে চাওয়ার অধিকার রয়েছে, সে কথা স্বীকার করা হয় না। কেন-না পিতৃতন্ত্র নিজের ক্ষমতার লাগামটি ধরে রাখতে মরিয়া। নারীকে সহনাগরিকের মর্যাদা দিলে তার আধিপত্যের প্রাসাদ যে ভেঙে পড়বে। তাই খাটো পোশাক, প্রেমে পড়া, পুরুষ বন্ধু থাকা, রাতে বাড়ির বাইরে বেরনো ইত্যাদি নানাবিধ কারণেই মেয়েদের খারাপ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। তাকে হেনস্তা করাও কার্যত মান্যতা পেয়ে যায়। সেখানেই ‘লাপাতা লেডিস’ এনে দাঁড় করায় ফুলকে। লক্ষ্মীমন্ত ভারতীয় নারীর মতো যে ‘নামিয়ে চক্ষু, মাথায় ঘোমটা টেনে’ চলতেই শিখেছে। কিন্তু একা অপরিচিত স্টেশনে হারিয়ে যাওয়া সেই মেয়েটিও নির্যাতিত হতে পারত বইকি। জয়ার স্বামী লম্পট প্রদীপের সঙ্গেই তাকে ঘটনাচক্রে এক করে দিতে চলেছিল জীবন, সেখান থেকে তো পালিয়েই বেঁচেছিল ফুল।
আর ফুলের সঙ্গেই এ ছবিতে হাজির থাকে জয়াও। পোশাক-পুরুষ বন্ধু-প্রেমের কারণে না হোক, কেবল প্রশ্ন তোলার জন্যেই যে বাড়িতে পুরোপুরি ভালো মেয়ে হতে পারে না। মেয়েদের নিজের শর্তে বাঁচার অধিকার সমাজ কেড়ে রাখে বলেই জয়ার আরও পড়াশোনা করতে চাওয়ার ইচ্ছাকে মেরে ফেলা হয়। তবুও জয়া নিজের অধিকার খুঁজে ফেরে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দেওয়ার পর অন্ধকারে হারিয়ে যেতে যেতেও জীবন যখন আরেকটা সুযোগ এনে দেয়, সাহস করে মিথ্যে পরিচয়ের আড়াল নিয়ে জয়া সেই খড়কুটো আঁকড়ে ধরে।
:আরও শুনুন:
নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন দেশজুড়ে, অথচ সিরিয়াল জুড়ে সেই গার্হস্থ্য হিংসা
এ এমন এক সময়, মেয়েরা যখন নিজেদের অধিকার এবং অধিকারহীনতাকে চিনতে চিনতে পথ হাঁটছেন। সমাজের এইসব অধিকার কেড়ে নেওয়া, অধিকারের বিরুদ্ধে দেওয়াল তোলা, ভুল বোঝানোর ছলচাতুরির উলটো দিকে দাঁড়িয়ে নিজেদের স্বর আরও স্পষ্ট করছেন তাঁরা। সমস্তরকম নির্যাতনের পালটা অধিকার দখলের কথা বলছেন। সেই প্রেক্ষাপটেই, রুপোলি দুনিয়াতেও যে মেয়েদের এই পথ হাঁটার কথা গুরুত্ব পেল, তা কোথাও নারীর এই স্বর খুঁজতে চাওয়াকে আরেকটু এগিয়েই দিল, এমনটা ভাবা যেতেই পারে। মনে করে নেওয়া যাক, সম্প্রতি বুকার পুরস্কারের মনোনয়ন তালিকাতেও ঠাঁই করে নিয়েছেন পাঁচজন নারী। বুকারের ৫৫ বছরের ইতিহাসে ছটি মনোনীত বইয়ের মধ্যে পাঁচটিই যে কোনও লেখিকার কলমে উঠে এল, এও এক ইতিহাস। আশা করা যায়, নানা পথে এমন একটু একটু করে এগোনোই মেয়েদের একদিন পৌঁছে দেবে সেই চাঁদের পাহাড়ের দিকে, সমস্ত হেনস্তা-নির্যাতন-প্রতিকূলতাকে জয় করে যার শীর্ষে উড়ছে মেয়েদেরই বিজয়নিশান।