‘ডাইনি সন্দেহে মারধর’, ‘ডাইনি অপবাদে পিটিয়ে খুন’- এই শিরোনাম কি খুব অচেনা! এখনও খবরের পাতা খুললেই কি চোখে পড়ে যায় না এমন শিরোনাম! অথচ এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ তো আমাদের দেশ হওয়ার কথা ছিল না! একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এখনও প্রদীপের তলায় লুকিয়ে হাজারটা কুসংস্কারের অন্ধকার। কিন্তু সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আলো জ্বেলে দেখানোর স্বপ্নটা কিন্তু সহজ ছিল না। এ বারের পদ্ম-মঞ্চে সম্মানিত করা হল সেরকমই এক আলোশিখাকে। যার নাম ছুটনি মাহাতো। শুনে নিন সেই অন্ধকারের ভিতর তাঁর আলো হয়ে-ওঠার গল্প।
ছুটনি মাহাতো। বয়স ৬২ ছুঁই ছুঁই। এককালে ডাইনি অপবাদ দিয়ে ভিটেমাটি ছাড়া করেছিল শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। সঙ্গ দিয়েছিল গোটা গ্রাম। সেই সব নৃশংস অত্যাচারের দিনগুলো আজও ভুলতে পারেননি ছুটনি। তবে সেই যন্ত্রণাকেই মশাল করে তুলে ধরেছেন, যাতে আর কোনও ছুটনিকে এই দিন দেখতে না হয়। সমস্ত রকম কুসংষ্কাররের বিরুদ্ধে এখন ছুটনির নেতৃত্বেই কাজ করে চলেছেন অন্তত ৯০ জন মহিলা।
ঝাড়খণ্ডের সরাইকেল্লা-খরসোয়া জেলার ভোলাদিহি গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন ছুটনি। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীনই বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। হঠাৎই একদিন কপালে জুটে গেল ডাইনি অপবাদ। সেটা ১৯৯৫। ভাসুরের মেয়ের অসুস্থতার দায় চাপিয়ে দেওয়া হল ছুটনির ঘাড়ে। শুরু হয় মারধর। বাড়িঘর জ্বালিয়ে সমস্ত সম্পত্তি কেড়েকুড়ে নেওয়া হয়। বিদ্যুতের শক দেওয়া থেকে শুরু করে প্রস্রাব পর্যন্ত খেতে বাধ্য করা হয়েছিল। প্রায় নগ্ন অবস্থায় ঘোরানো হয়েছিল পুরো গ্রাম। পিটিয়ে খুনের চেষ্টা পর্যন্ত হয়।
আরও শুনুন: ডাক্তারের হাতে যৌন হেনস্তার শিকার, মুখ ফুটে মায়ের কাছেও বলতে পারেননি অভিনেত্রী
না, নেপথ্যের গল্পটা কিন্তু এতটাও সহজ নয়। একটি সাক্ষাৎকারে ছুটনি জানিয়েছেন, দেওর-ভাসুরেরা মিলে যৌনতায় বাধ্য করতে চেয়েছিল ছুটনিকে। রাজি না হওয়ায় ধর্ষণের চেষ্টা পর্যন্ত করা হয়। তার পরেই জোটে ডাইনি অপবাদ। স্থানীয় এক আইনজীবীর বাড়িতে আশ্রয়ের জন্য গিয়েছিলেন, সেখানেও মেলে ঠোক্কর। পুলিশের কাছেও ছুটে গিয়েছিলেন অভিযোগ জানাতে। অভিযোগ নেওয়া তো দূরের কথা, উলটে সেখানে তাঁর কাছ থেকে ঘুষ চাওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন ছুটনি। শেষমেষ কোনও মতে বাপের বাড়িতে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বাঁচেন ছুটনি।
এমনই পরিস্থিতিতে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন স্থানীয় এক আইএএস অফিসার। তিনিই অ্যাসোসিয়েশন ফর সোশ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান অ্যাওয়ারনেস (ASHA) নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন ছুটনির। যারা প্রধানত ডাইনিপ্রথা বা এই ধরনের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কাজ করে চলেছেন। সেই থেকে শুরু। যে ডাইনিপ্রথার শিকার হয়ে একদিন সমাজ ঘরবাড়ি সব ছাড়তে হয়েছিল, সেই ডাইনিপ্রথার বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়ালেন ছুটনি।
আরও শুনুন: শিকার গণধর্ষণের, তবু নারী পাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অক্লান্ত Sunitha Krishnan
বর্তমানে বীরবনস পঞ্চায়েতের আওতায় ডাইনি অপবাদে অত্যাচারিত হওয়া মানুষদের জন্য একটি পুনর্বাসন কেন্দ্র চালান ছুটনি। গড়ে তুলেছেন ডাইনি প্রথাবিরোধী আলোচনাকেন্দ্র। সেখান থেকেই সমাজের নানা স্তরে বার্তা ও সচেতনতা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এ ছাড়াও ৯০ জন মহিলা নিয়ে তৈরি ছুটনির একটি দল সর্বক্ষণ বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে নজরদারি চালায়। যাতে এই ধরনের ঘটনা আটকানো যায়। ছুটনি জানান, এখনও পর্যন্ত ডাইনি অপবাদ পাওয়া অন্তত ১২৫ জনকে বাঁচিয়ে এনেছেন তিনি। ১৯৯৬ সালে তাঁর জীবনের উপরে একটি তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছিল। ২০১৪ সালে ‘কালা সচ- দ্যা ব্ল্যাক ট্রুথ’ নামক বলিউড ছবিটিও তাঁর জীবনের উপরেই আধারিত।
তবে এত কিছুর পরেও কিচ্ছু বদলায়নি। কুসংষ্কার এখনও জড়িয়ে সমাজের পরতে পরতে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য বলছে ২০০১ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে ঝাড়খণ্ডে ৫৭৫ জন মহিলাকে ডাইনি অপবাদে মারধর করা হয়েছে। শুধু প্রত্যন্ত ভারতে নয়। তার মূল কিন্তু রয়েছে গোটা সমাজব্যবস্থাতেই। সেখানে বাদ যায় না অভিজাত উচ্চবিত্ত সমাজও। তাই আজও একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে প্রথমে গাছের সঙ্গে বিয়ে হয় এক তারকা অভিনেত্রীর। তার পর তিনি গাঁটছড়া বাঁধেন তাঁর অভিনেতা-প্রেমিকটির সঙ্গে।
বাকি অংশ শুনে নিন।