ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ঝলসে গেছে শরীর। কুঁচকে গেছে মুখের অনেকখানি অংশ, গলা, হাত। তবু থেমে থাকেনি জীবন। লড়াই করে ঠাঁই পেয়েছেন বিশ্বের সেরা একশো নারীর তালিকায়। করেছেন অজস্র লেখালেখি, বানিয়েছেন সিনেমাও। কেমন ছিল তাঁর জীবনের গল্প? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
এ যেন এক অন্য বাংলাদেশের গল্প। যেখানে অস্থিরতা নেই, হানাহানি নেই, আছে ভালোবাসার গল্প, ভালো থাকার গল্প। বিগত কয়েক মাস ধরে যে বাংলাদেশকে গোটা বিশ্ব দেখছে, সেই বাংলাদেশের কথাই অন্যভাবে উঠে এলো ভূমিকন্যার হাত ধরে। ‘অগ্নিদগ্ধ’ তকমাকে বুড়ো আঙুল বিশ্বসেরা একশো নারীর তালিকায় নিজের নাম তুলেছেন জান্নাতুল ফিরদৌসী।
কথায় বলে, ‘মনের ইচ্ছেই আসল শক্তি’। কিন্তু সবসময় কি মানি? আর তাই রোজকার ছোটখাটো বিষয়ে হয় মুখভার, ঘিরে ধরে হতাশা। প্রতিদিন যাপনের যে হিসাব আমরা লিখে চলেছি, সেই হিসেবেই অন্য মোড় নিল জান্নাতুল ফিরদৌসের গল্প। চোখে আঙুল দিয়ে যিনি দেখিয়ে দিলেন, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ের অন্য নাম জীবন। সৃষ্টি করেছেন সাহিত্য, তৈরি করেছেন সিনেমাও। বলা হয়, দহনের দানে শুদ্ধ হয় ধাতু। হয়ে ওঠে আরও মজবুত, উজ্জ্বল। জান্নাতুল ফিরদৌস বোধহয় এমনই এক ধাতুতে গড়া। সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে থাকেন। অসাধারণত্ব তাঁর ব্যক্তিত্বে। একটি দুর্ঘটনায় তাঁর গায়ে আগুন লেগে যায়। পুড়ে যায় শরীরের প্রায় ৬০ শতাংশ। কিন্তু তাতে কী? যাঁর মধ্যে আছে অদম্য প্রাণশক্তি, তাঁকে রুখবে কার সাধ্যি? তাই জ্বালাপোড়ার যাবতীয় যন্ত্রণা সয়ে উঠে দাঁড়ালেন জান্নাতুল। বহু লোকই তাঁকে চেনেন আইভি নামে।
আরও শুনুন: হাত নেই, আছে স্বপ্ন! পা দিয়েই ছবি আঁকেন এই শিল্পী, কুর্নিশ নেটদুনিয়ার
অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর ঝুলিতে এসেছে সামাজিক বিজ্ঞানে স্নাতক, ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের ডিগ্রি। শুধু কি তাই? এলএলবি এবং ডিপ্লোমা ইন সোশ্যাল কমপ্লায়েন্সেও তিনি অর্জন করেছেন ডিপ্লোমা ডিগ্রি। পাশাপাশি চলতে থাকে কলম। অল্প সময়ের মধ্যেই লেখিকা হিসেবে সবাই চিনে ফেলল তাঁকে। তবে এখানেও থেমে থাকেননি তিনি। সিনেমার পরিচালনা করে একেবারে তাক লাগিয়ে ফেলেছেন এই অগ্নিকন্যা। একদিকে উকিল হিসেবে জোরকদমে প্র্যাকটিস চলছে আদালতে, অন্যদিকে তিনি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন একটি এনজিও। নাম ‘ভয়েস অ্যান্ড ভিউস’। এনজিওটি কাজ করে পিছিয়ে পড়া মহিলাদের নিয়ে, শিশুদের নিয়ে, প্রতিবন্ধী মানুষদের নিয়ে। মোটকথা সমাজের সব রকম অন্ধকারে একদিন জ্বলে উঠবে আগুনের শিখা, জান্নাতুলের লক্ষ্য শুধু এই।
সম্প্রতি বিশ্বের ১০০ জন প্রভাবশালী নারীর যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে সেখানে উজ্জ্বল তাঁর নাম। যে তালিকায় রয়েছে প্রাক্তন মার্কিন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা, মানবাধিকার আইনজীবী আমাল ক্লুনি, ব্যালন ডি’অর বিজয়ী ফুটবলার আইতানা বনমাতি, এআই বিশেষজ্ঞ টিমনিট গেব্রু, নারীবাদী আইকন গ্লোরিয়া স্টেইনেম, হলিউড তারকা আমেরিকা ফেরেরা এবং হুদা কাতানের মতো ডাকসাইটে নাম, সেই তালিকারই একটি অংশে এসে আটকে যায় চোখ। কারণ সেখানে জ্বলে উঠছে এই আগুনপাখির নামটিও। প্রতিবন্ধকতাতেও আছে নানারকম ভাগাভগি। কখনও তা শারীরিক, কখনও মানসিক, আবার কখনও বা পারিপার্শ্বিক। কিন্তু সেসব যে শেষমেশ কাউকে আটকে দিতে পারেনা, তার প্রমাণ জান্নাতুলের মতো নারীরাই।