নারীসুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন সর্বত্রই। সমস্ত পিঙ্ক পার্কই সুরক্ষিত? তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবু প্রতিনিয়ত নানাবিধ নিয়মকানুন কিংবা চোরাগোপ্তা আক্রমণের কথা মাথায় রেখে চলতে হয় যাঁদের, তাঁদের এই আন্তরিক পরিসরের চাহিদাটুকু আমাদের অন্য প্রশ্নের সামনে এনেও দাঁড় করায়। কেনই বা ইচ্ছেমতো ঘোরাফেরার জন্য তাঁদের আলাদা জায়গা খুঁজে নিতে হবে। আজও এ পরিস্থিতির বদল কি সম্ভব নয়!
বাংলাদেশের বিখ্যাত রাজু ভাস্কর্যের নারীমূর্তির মাথায় উঠেছে হিজাব। সে-দেশের সংবাদমাধ্যমে ঘটনাটির কথা প্রকাশিত হওয়ার পর নানা মহলে উঠেছে বিভিন্ন প্রশ্ন। সে প্রশ্ন মূলত নারী স্বাধীনতা নিয়েই। প্রশ্নটি আদতে যেমন গভীর, তেমনই বহুমাত্রিক। আর তাই স্থানভেদে তার রূপও পালটে পালটে যায়। আমাদের দেশে হিজাব বিরোধী আন্দোলন কিছুদিন আগেই ছিল খবরের শিরোনামে। তা নিয়ে সময়ে সময়ে ঘনিয়ে উঠেছে বিতর্কও। তবে, সেই সব তর্ক-বিতর্কের বাইরে গিয়ে নিজেদের জন্য স্বাধীন ঘোরার জায়গা তৈরি করে নিয়েছেন দিল্লিবাসী মহিলারা। যেখানে বোরখার আড়াল তাঁরা সরিয়ে রাখতে পারেন অনায়াসে।
পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। শুধুমাত্র নারীদের জন্য ক্লাব। এইরকম পরিসরের ধারণা রাজধানীতে নতুন নয়। ‘পিঙ্ক পার্ক’ নামে পরিচিত এই জায়গাগুলোকে এক কথায় বলা যায়- আন্তরিক মহিলামহল। এ কথা ঠিক যে, এই আধুনিক প্রগতিশীল সময়েও মহিলাদের নানা বিষয়ে সদা সতর্ক থাকতে হয়। পথেঘাটে কুদৃষ্টির শিকার কিংবা অনভিপ্রেত খারাপ স্পর্শের অভিজ্ঞতার কথা তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই জানান। প্রতিবাদ করেন। মুখ বুজে মেনে নেওয়ার দিন ঘুচিয়ে মহিলারা এখন এ নিয়ে সরব হন, সঙ্গত কারণেই। তবু, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার দরুণ সামগ্রিক যে ‘ট্রমা’ মহিলাদের মধ্যে কাজ করে, তা থেকে যেন সহজে নিষ্কৃতী মেলে না। যেন অদৃশ্য এক নজরদারি এখনও তাঁদের উপর চলতে থাকে। এমন অস্বস্তির অনুভব মুছে ফেলার মতো পরিণত এখনও হয়ে ওঠেনি আমাদের সমাজ। এ নিয়ে যুক্তি-প্রতিযুক্তি সাজিয়ে তর্ক জমিয়ে তোলা যেতে পারে। তবে মহিলারা বেশ জানেন, অন্তর্বাসের সামান্য সুতো বাইরে বেরিয়ে থাকলেও দৃষ্টির বাণ তাঁদের দিকেই ছুটে আসে। ভিড় যানবাহনে তাঁদের যে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ রাখতে হয়, তা তাঁদের থেকে ভালো আর কে জানেন!
এই অরণ্যে তাহলে মুক্তি কোথায়? অন্তত খানিকটা সময় সবরকম নজরদারি, পুরুষতান্ত্রিক যাবতীয় দৃষ্টির বাইরে বেরিয়ে নিজেদের ইচ্ছেখুশির একটা পরিসর তাই তাঁরা নির্মাণ করে নিয়েছেন। সেই ভাবনা থেকেই পিঙ্ক পার্ক বা পিঙ্ক ক্লাবগুলোর জন্ম। সেই মোঘল আমলে নারীদের জন্য বরাদ্দ নিজস্ব জায়গা হয়তো এই ভাবনার উৎস। তবে দিনে দিনে তা আধুনিক হয়ে বর্তমান জীবনেও জায়গা করে নিয়েছে। বলা যায়, এই ক্লাবগুলো সদর্থেই যেন নারীর একচিলতে স্বাধীন আকাশ।
ঠিক যেমন দরিয়াগঞ্জের পর্দা-বাগ। নানা বয়সের মহিলারাই এখানে আসেন। মুসলিম মহিলারা অনায়াসে তাঁদের বোরখা খুলে রাখেন এখানে। বাচ্চাদের নিয়ে খেলাধূলা করেন কিংবা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব। তাঁরা জানেন, এই পরিসরে তাঁদের উপর কোনও নিয়মের চাদর চাপানো নেই। অতএব তাঁদের ঠিক যা ইচ্ছে, ঠিক সেভাবেই সময় কাটান তাঁরা। যাঁদের সেরকম ‘পোশাকি’ বাধ্যবাধকতা নেই, তাঁরাও আসেন এখানে। কেন? যাঁরা হয়তো গৃহবধূ, বাড়ির মধ্যে মি-টাইম বলতে যা বোঝায় তা তাঁরা কস্মিনকালেও পান না। অতএব এই পার্কে এসে কিছুক্ষণের জন্য সবকিছু থেকে মুক্তি। যে তরুণীদের নানা নিষেধ মেনে চলতে হয় এখনও, তাঁরাও যেন খানিক বাঁচার অক্সিজেন পান এই পার্কে এসে। সবথেকে বড় কথা, নানা বয়সের বহু মহিলা পরস্পরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় যেন আত্মীয় হয়ে ওঠেন। যে ‘সিস্টারহুড’ তৈরি হয়, তা তাঁদের কাছে বড় পাওনা।
রাষ্ট্রসংঘের রিপোর্ট বলছে, গোটা বিশ্বে ২০০ কোটির বেশি কিশোরী এবং পরিণত বয়সের মহিলা কোনোরকম সামাজিক সুরক্ষা পান না। নারীসুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন সর্বত্রই। সমস্ত পিঙ্ক পার্কই সুরক্ষিত? তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবু প্রতিনিয়ত নানাবিধ নিয়মকানুন কিংবা চোরাগোপ্তা আক্রমণের কথা মাথায় রেখে চলতে হয় যাঁদের, তাঁদের এই আন্তরিক পরিসরের চাহিদাটুকু আমাদের অন্য প্রশ্নের সামনে এনেও দাঁড় করায়। কেনই বা ইচ্ছেমতো ঘোরাফেরার জন্য তাঁদের আলাদা জায়গা খুঁজে নিতে হবে। আজও এ পরিস্থিতির বদল কি সম্ভব নয়!
যদি সম্ভব হয়, তবে, আর কবে?