সিনেমায় নবতরঙ্গের পথিকৃৎ। শুধু সিনেমার ভাষা নয়, শিল্প যে বাস্তবতার সঙ্গে সন্নিহিত, সময়ের অন্তরাত্মা স্পর্শ করে সেই বোধের পথেই হেঁটেছেন শ্যাম বেনেগাল। সত্যজিৎ রায় তাঁর আইডল। শ্যামকে আদর্শ করে আরও চলচ্চিত্র পরিচালক পথ হাঁটা শুরু করেছেন। শ্যাম যেন সেই যুগসন্ধিক্ষণের চিহ্ন হয়ে থেকে গেলেন ভারতীয় সংস্কৃতিতে। লিখছেন আবেশ কুমার দাস।
সিকি শতাব্দী আগের কথা। এক সাক্ষাৎকারে শাবানা আজমির একটি মন্তব্য দিয়েই শুরু করা যাক। বাংলা রুপোলি পর্দার ইতিহাসে যে গুরুত্ব ও তাৎপর্য ‘পথের পাঁচালী’-র, শাবানার মতে, বম্বেতে বহুলাংশে সেই ভূমিকাই ছিল ১৯৭৪ সালে মুক্তি পাওয়া একটি ছবির (Shyam Benegal)। ঘটনাচক্রে যা ছিল অভিনেত্রীর জীবনের প্রথম ছবি-ও।
নিজের কেরিয়ার সম্পর্কেই দু-একটা তাৎপর্যপূর্ণ কথা আসলে বলছিলেন সেদিন শাবানা। যেমন মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ঠিক যে সময় বলিউডে এলেন তিনি, সত্তরের বম্বেকে তখন শাসন করছেন ড্রিমগার্ল হেমা মালিনী। নিজস্বতায় আস্থা রাখা এবং হেমার সঙ্গে ডুয়েল লড়তে না নামাই ভবিষ্যতের ব্র্যান্ড শাবানার প্রাথমিক ভিত্তি বলে সেদিন মন্তব্য করেছিলেন কাইফি আজমির অভিনেত্রী কন্যা।
তবে নব্বইয়ের শেষ প্রহরে যত সহজ ছিল কথাগুলো বলা, দু’দশক আগে ওই রাস্তায় হাঁটতে শুরু করা অতটাও নিরাপদ ছিল না বোধহয়। যেহেতু, বাংলায় প্যারালাল ছবির যে ধারা ততদিনে স্বীকৃত, হিন্দি ছবির দর্শকের কাছে সেই ধারার পরিপূর্ণ রূপটি শ্যাম বেনেগালের (Shyam Benegal) ‘অঙ্কুর’-এর আগে সেভাবে ধরা দেয়নি বললেও অত্যুক্তি হয় না। নিজের কেরিয়ার প্রসঙ্গে বলতে গিয়েই ‘অঙ্কুর’-এর কথায় তাই সেদিন খোদ ‘পথের পাঁচালী’-কে টেনে এনেছিলেন শাবানা।
শ্যাম বেনেগালও (Shyam Benegal) বলতে গেলে অন্ধ ভক্তই ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের। ভাবতে গিয়ে আজ অবাকই লাগছে, জন্ম ও মৃত্যুদিবসের পারস্পরিক দূরত্ব কী অদ্ভুত সমাপতনই না ঘটিয়ে গেল গুরুশিষ্য উভয়ের বেলাতেই! বাহাত্তরতম জন্মদিনের ঠিক দশ দিন আগে যদি চলে যেতে হয় সত্যজিৎ রায়কে (২ মে, ১৯২১— ২৩ এপ্রিল, ১৯৯২), কোঙ্কনিভাষী ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান শ্যাম বেনেগালও প্রয়াত হলেন একানব্বইতম জন্মদিনটি পুরনো কলাকুশলীদের সঙ্গে হইচই করে কাটানোর ঠিক দশ দিনের ব্যবধানেই (১৪ ডিসেম্বর, ১৯৩৪— ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪)। ঠিক দশ দিন। শুধু আগে আর পরে। কোথায় যে লেখা হয় এসব চিত্রনাট্য!
নাসিরুদ্দিন শাহ থেকে রাজিত কাপুর, শাবানা আজমি থেকে স্মিতা পাতিল। ভারতীয় নবতরঙ্গ ছবির একঝাঁক কলাকুশলীর কেরিয়ার সঠিক দিশা পায় যাঁর দৌলতে, নির্দেশক হিসেবে তাঁর বলিউডে যাত্রারম্ভের দিনগুলি চরিত্রে কেমন ছিল ঠিক? মনে রাখতে হবে ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন কাটছে সত্তরের দিনগুলি। রাজ কাপুরের (যাঁর জন্মদিনও ওই ১৪ ডিসেম্বর-ই, সম্প্রতি ধূমধামের মধ্যেই পার হল জন্মশতবর্ষ) পঞ্চাশের সোশালিস্ট ছবিরা যখন স্রেফ সাদাকালো স্মৃতি। ওই রেডক্রশের ফান্ড কাটার মুহূর্তে সত্যজিতের ছবিতে দেখানো সেই মেসের ঘরে যার আবছা গানের কলি ভেসে আসে রেডিয়ো থেকে। মূল্যবোধের অবক্ষয় আর সামাজিক দুর্নীতির প্রতিফলন রুপোলি পর্দায় ঘটছে মারদাঙ্গা আর অপরাধজগতের খুল্লমখুল্লা উপস্থাপনায়। এমনকী মিষ্টি প্রেমের ছবিও তত কল্কে পাচ্ছে না সেদিন মেনস্ট্রিমের দর্শকের কাছে। সূক্ষ্ম জীবনবোধের কথা ভাবাটাই এই বাজারে নির্দেশক হিসেবে ছিল এক বড় চ্যালেঞ্জ।
এখানেই মাহাত্ম্য শ্যাম বেনেগালের(Shyam Benegal)। ‘অঙ্কুর’, ‘নিশান্ত’, ‘মন্থন’, ‘ভূমিকা’ বা ‘জুনুন’— জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত পরপর ছবি উপহার দিয়েছেন সেই দশকটা জুড়েই। কিন্তু অবক্ষয়, দুর্নীতি বা পেশিশক্তির আস্ফালনের মতো যে অনুষঙ্গগুলির কথা বলা হল সদ্যই, তাদের এড়িয়ে সূক্ষ্মতার আরাধনা করতে যাননি কখনও। বরং গ্রামীণ ভারতবর্ষের বাস্তব সমস্যা, জাতিভেদের সমস্যা থেকে নারী নির্যাতন, দেহব্যবসার জ্বলন্ত অনুষঙ্গ অক্লেশে উঠে এসেছে তাঁর ছবিতে। আবার বিষয়বৈচিত্রে নিজের আইডল সত্যজিৎ রায়ের মতোই অনন্য থেকেছেন বরাবর। এই আধুনিক মনোভঙ্গির তাড়না থেকেই তাঁর ছবির নারীরাও অনন্যা। যেহেতু আমরা জানি, ‘Modernism is less a style than a constant search for style.’ তাই, ‘অঙ্কুর’-এর লক্ষ্মী যদি গ্রামীণ সামন্তপ্রভু সূর্যর বিরুদ্ধে কণ্ঠ তোলে শেষ অবধি, ‘ভূমিকা’-র উষা আশ্রয়দাতা বিনায়ক কালের গৃহের নিরাপত্তা ছেড়ে নিষ্কর্মা স্বামীর ঘরেই ফিরে আসতে দ্বিধা করে না। ‘জুনুন’-এর রাথ লাবাডোর মাতার অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে হেঁটে আসতে চায় জাভেদ খানের কাছে। এবং বিলেতে ফিরে যেতে হলেও আজীবন রয়ে যায় অবিবাহিতা। খেয়াল করার, সমকালীন বলিউডের স্বাভাবিক প্রবণতার ছাঁচে কিন্তু ফেলা যায় না এই নারীদের। নায়কের সঙ্গী হয়ে নাচগান আর প্রেমালাপেই সাঙ্গ হয়নি ছবিতে তাঁদের ভূমিকা। গৃহবধূ হয়ে থাকার প্রাথমিক অভিপ্রায় সত্ত্বেও কেশব দালভির মতো স্বামীকেও যেমন পরিত্যাগ করতে পারে উষা, আবার ‘মন্থন’-এর বিন্দু পরিস্থিতির প্ররোচনায় দুর্বল হয় ডক্টর রাওয়ের প্রতি। কোনও সনাতন সংস্কার বিশেষ আমল পায়নি এসব পরিস্থিতিতে। বলিউডের ছবি হয়েও এভাবেই মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইন্ডিয়ান নিউ ওয়েভ ছবি হয়ে ওঠা শ্যাম বেনেগালের (Shyam Benegal)ছবিদের।
প্রসঙ্গত মনে পড়বে শাবানা আজমির কথাটা। সত্যি এটাই যে, সমকালে হেমা মালিনীর জুতোয় পা গলানোর চেষ্টা যেমন করেননি শাবানা, প্রকারান্তরে নিজস্বতা প্রদর্শনের সুযোগও এসেছে তাঁর। সুযোগটা করে দিয়েছিল প্রথমত এখানে উল্লিখিত ছবিগুলি এবং অতঃপর শ্যাম বেনেগালের পথ ধরেই গোবিন্দ নিহালনি, গৌতম ঘোষ, কেতন মেহতা বা সইদ মির্জাদের মতো নির্দেশকদের সিনেমার পৃথিবীতে চলে আসা। বলে নেওয়া দরকার একটা সময় ‘সারাংশ’-এর মতো আর্ট ছবি নির্মাণ করতে দেখা গিয়েছিল মহেশ ভাটকেও। যাক, বলা হচ্ছিল যে কথাটা। স্রেফ শাবানা আজমির বেলাতেই খাটে না কথাটা, নাসিরুদ্দিন শাহ, স্মিতা পাতিল, কুলভূষণ খারবান্দা বা রাজিত কাপুরের মতো দিকপাল অভিনেতাদেরও নিজ নিজ শক্তিমত্তা প্রদর্শনের সুযোগ এভাবেই করে দিয়েছিল ভারতীয় সিনেমার নবতরঙ্গ। নয়ের দশকের শেষলগ্নে দাঁড়িয়ে ‘অঙ্কুর’-এর কথায় কেন শাবানার মনে পড়ে সত্যজিতের ভুবনবিজয়ী ছবি ‘পথের পাঁচালী’-কে, বোধহয় খানিকটা বোঝা যায় এখান থেকেই।
আর-একটি দিক থেকেও নিঃসন্দেহে শ্যাম বেনেগালকে (Shyam Benegal)বলা যাবে পথিকৃৎ। ‘হোয়াইট রেভোল্যুশন’-এর বাস্তব ঘটনাক্রমের ছায়ায় নির্মিত ‘মন্থন’ আক্ষরিক অর্থেই ভারতবর্ষের প্রথম ক্রাউড ফান্ডেড ছবি। যার প্রযোজক হিসেবে পর্দায় নাম আছে গুজরাত কো-অপারেটিভ মিল্ক মার্কেটিং ফেডারেশন লিমিটেডের, যার সদস্য গোয়ালাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত চাঁদার টাকায় নির্মিত হয় গিরিশ কারনাড, স্মিতা পাতিল, অমরীশ পুরী অভিনীত ছবিটি। নির্দেশকের স্মৃতিচারণায় জানা যায়, শুটিং চলাকালে দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে গরুর গাড়ি চেপে গোয়ালারা আসতেন তাঁদের ‘নিজেদের’ ছবিটির কাজ দেখতে। প্রসঙ্গত, চলতি বছর মে মাসে সাতাত্তরতম কান চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয় ‘মন্থন’-এর ডিজিটালি রেস্টোরড সংস্করণ।
দীর্ঘ কেরিয়ারে চব্বিশটি কাহিনিচিত্র নির্মাণ করেছেন। তথ্যচিত্রের কাজ তো শুরু করেছিলেন ১৯৬২ থেকেই। খেয়াল করার, রুপোলি পর্দায় ধরেছেন গান্ধি, নেতাজি ও বঙ্গবন্ধুকে (জীবনের শেষ কাজ, ২০২৩ সালে, বাংলাদেশ ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের প্রযোজনায় ‘মুজিব: দ্য মেকিং অব্ আ নেশন’)। দূরদর্শনের জন্য করেছেন কাজ। অর্জন করেছেন আঠেরোটি জাতীয় পুরস্কার। অশক্ত শরীরেও শেষ অবধি নতুন ছবির ভাবনা ছিল মাথায়। ‘অঙ্কুর’-এর মুক্তির পঞ্চাশতম বছরেই চলে গেলেন ভারতীয় নবতরঙ্গের অগ্রদূত শ্যাম বেনেগাল। ভারতীয় সিনেমা জানে, সময়-বাস্তবতা আর বোধের নিরখে, এ পৃথিবী একবারই পায় শ্যাম বেনেগাল (Shyam Benegal) নামে বিস্ময়কে।
ছবিঋণ: ফিল্ম হিস্ট্রি পিক্স (এক্স হ্যান্ডেল)