অন্যের ব্যাপারে নাক গলানোর স্বভাব আমাদের মজ্জাগত। এমনকী একজনের চেহারা ঠিক কেমন, রোগা না মোটা, লম্বা না বেঁটে, ফরসা না কালো, এই নিয়েও অন্য অনেকের মতামত দেওয়ার শেষ থাকে না। উলটোদিকের মানুষটি আদৌ সেই মত চাইছেন কি না, তা জানারও প্রয়োজন নেই। সময় যতই এগোক, জীবনযাপনের মান যতই বদলাক, এই মানসিকতা পালটেছে কি? তাহলে, ‘বডি শেমিং’-কে সামলানো যাবে কীভাবে?
একুশ শতকে পৌঁছলে কী হবে, মেয়েদের চেহারা আর সাজপোশাক নিয়ে নিন্দেমন্দ কিন্তু চলছেই। শরীর সম্পর্কে এহেন কটূক্তি করার পোশাকি নাম, ‘বডি শেমিং’। শব্দ দুটো নিশ্চয়ই জানা। কিন্তু যাকে বা যাদের নিয়ে শেমিং করা হয়, তাদের মনে এর কী ছাপ পড়ে, সেদিকটা জানা যায় না অনেক সময়েই।
মনে করুন, কোনও পোশাক পরতে গিয়ে কেউ শুনলেন, ‘ভারী চেহারায় এটা মানাবে না’। অন্য কেউ আবার কোনও পোশাক পরলে শুনছেন, ‘এটা কী পরেছিস? এ তো হ্যাঙ্গারে ঝুলছে।’ শ্যামলা রঙের মেয়েদের গায়ে কোন কোন বিশেষ রং খুলবে না, তার তালিকা পেয়েছেন কেউ কেউ। কারও বোঁচা নাক নিয়ে সমস্যা তো কেউ ছোট চোখ নিয়ে ঠাট্টা শুনতে শুনতে নাজেহাল। নিজের জীবনে, কিংবা নিজেদের চেনা পরিচিতদের জীবনে এই সিনারিওগুলো যথেষ্ট কমন, তাই না? শুধু আমি-আপনি নই, বডি শেমিং রেহাই দেয় না কাউকেই। কখনও স্থূল চেহারার জন্য ট্রোলড হন বিদ্যা বালান। গায়ের রং বাদামি বলে প্রিয়ঙ্কা চোপড়া ট্রোলড হন বিদেশের স্কুলে। সোশাল মিডিয়ার যুগে বডি শেমিং করা তো আরোই সহজ। এর দৌলতে অপরিচিত কাউকেও ভার্চুয়ালি অপদস্থ করা যায়। সদ্য মা হওয়া নায়িকার স্বাভাবিক মেদবৃদ্ধি, নায়কের স্ত্রীর চেহারা বা পোশাক সব কিছুকেই ট্রোল করা যায় অনায়াসেই।
আরও শুনুন : বুক ফাটলে এখন মুখও ফোটে, মেয়েদের প্রতিবাদের মঞ্চ Social Media
‘শেমিং’ বলছি কেন? নিছক মজা বলেও তো ধরে নেওয়া যেত একে, তাই না? আপনারাই বলুন না, এই কথাগুলো যতবার শুনেছেন, কখনও কি খুশি হয়েছেন শুনে? নাকি মনে মনে সংকুচিত হয়েছেন, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিচার করতে চেয়েছেন ওরা ঠিক না ভুল?
আসলে, একটা কথা মনে রাখতে হবে, নির্মল রসিকতা আর অকারণে ব্যঙ্গ করার মধ্যে কিন্তু তফাত রয়েছে। কাউকে যদি বারবার তার চেহারা নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করা হয়, তার মনে তৈরি হয় ক্ষত। বিশেষত সে যদি মেয়ে হয়। কারণ, আজকের যে বাজারকেন্দ্রিক সভ্যতা, সেখানে সৌন্দর্যের একটা মাপকাঠি তৈরি করে দেওয়া হয়। সেই মাপক ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে। বাজারচলতি কসমেটিক্সের বিজ্ঞাপন দেখলেই এ কথা নিয়ে আপনার কোনও সন্দেহ থাকবে না।
কী দেখা যায় সেখানে?
ধরুন, কোনও বিশেষ সাবান ত্বককে এমন উজ্জ্বল করে তোলে যে, সেই মেয়ের কাছে এসে ধরা দেয় অন্য কারও প্রেমিক। কিংবা ধরুন, একটি বিশেষ প্রোডাক্ট বদলে দিতে পারে আপনার গায়ের রং, আর তা হলেই চাকরি থেকে বিয়ে, সবেতেই আপনি হয়ে উঠবেন টপার।
বুঝতেই তো পারছেন, মাথার বাইরের অংশটা নিয়েই সবার যত মাথাব্যথা। এই পরিস্থিতিতে যে মেয়েটি বড় হয়ে উঠছে, সেও পুরুষের দৃষ্টিকে তার চেহারার এক ও একমাত্র বিচারক বলে ভাবতে শিখবে, তাই না? সুতরাং, তার গড়ন বরন আকার আয়তন ইত্যাদি নিয়ে যত কথা বলা হবে, তার অবচেতনে তাকে প্রত্যাখ্যান করে চলবে কোনও পুরুষদৃষ্টি। এর ফলে সে ক্রমশ নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নিতে পারে। ডুবে যেতে পারে অবসাদে। যে-কোনোরকম জমায়েতকে সে ভয় পাবে, কারণ আর কোনও মানুষের মুখোমুখি হওয়া মানেই আরেকবার যাচাইয়ের মুখে পড়া। এমনকি, এমনও হতে পারে যে কোনও পুরুষকে বিশ্বাস করতেই অসুবিধা হবে তার। বারবার নিজের চেহারা নিয়ে মতামত শুনতে শুনতে তার মনে কী ধারণা বদ্ধমূল হবে? যে, তথাকথিত সুন্দর চেহারা না হলে কারও কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠা যায় না।
সমস্যার কথা তো অনেক হল, এবার চলুন তো, সমাধান খোঁজার চেষ্টা করা যাক। খামোখা অন্য কেউ আপনার মনখারাপ করিয়ে দেবে, এ ঘটনা বারবার ঘটতে দেবেন কেন?
আরও শুনুন : Home + Work From Home – সব সামলে কেমন আছেন কর্মরতা মহিলারা?
ভাবছেন তো, ব্যক্তিগত পরিসরে কেউ বডি শেমিং করলে তাকে কীভাবে থামাবেন? সিম্পল, আপনার ভালো না লাগার কথা স্পষ্ট করে জানান। বলুন, আমি কেমন দেখতে এই নিয়ে এখন আলোচনা করতে চাইছি না। জোর গলায় বলুন, আমার নিজেকে নিজের দিব্যি লাগে। আর কেবল বলা নয়, নিজে বিশ্বাস করুন এই কথাটাই। ওজন যদি আপনার শারীরিক সুস্থতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তবে নিশ্চয়ই আপনি ওজন নিয়ন্ত্রণ করবেন। কিংবা যদি আপনার নিজেকে অন্যভাবে দেখতে ইচ্ছে করে, তার জন্য রূপচর্চা করবেন। নিজের মন ভালো করার জন্য সাজবেন। কিন্তু আপনাকে ঠিক কেমন থাকলে ভালো দেখাবে, এই মাপকাঠি ঠিক করার ভার অন্যের হাতে তুলে দেবেন না কখনোই। আপনি যদি নিজেকে নিয়ে সুস্থ থাকেন, স্বচ্ছন্দ বোধ করেন, তা হলে সেই অনুভবকেই গুরুত্ব দিন।
ভাবুন না, সব্বাইকে পুতুলের মতো এক ছাঁচে তৈরি করলে কেমন একঘেয়ে লাগত আপনার চারপাশটা! প্রতিটি মানুষের চেহারা আলাদা, চরিত্র আলাদা, ভিন্ন ব্যক্তিত্ব, ভিন্ন গড়ন। একই মানুষের চেহারা বয়স অনুযায়ী বদলায়। সেই আলাদা রকম চেহারার সঙ্গে মানিয়েগুছিয়ে ভালো থাকাই তো আসল কথা।
সুতরাং, নিজেকে ভালবাসুন। সমস্ত দিক দিয়ে ভালবেসে ফেলুন। নিজেকে ভাল রাখুন। বডি শেমিংয়ে কান দিয়ে নিজেকে বদলে ফেলতে বয়েই গেছে আপনার!