ত্রিলোকের সকল পুরুষের অবোধ্য মহিষাসুরকে বধ করতে আবির্ভূতা হয়েছিলেন দেবী দুর্গা। কেবল পূরাণে নয়, কালেই কালেই এমনটা হয়েছে। বিশ্বাস না হয়, ঘুরে আসুন ছত্তীসগঢ় থেকে। যেখানে সমাজ থেকে গার্হস্থ্য হিংসা বা পাচারের মতো অপরাধকে মুছে ফেলে দিতে পুলিশ প্রশাসন নয়, হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন সাধারণ গৃহবধূরা। প্রমীলাবাহিনীর প্রতাপে যেখানে থরহরিকম্প অপরাধীরা। আসুন শুনে নিই তাঁদের গল্প।
মাথায় তাঁদের মেরুন রঙের বেরেটস। ওই পুলিশ বা হাবিলদারের মাথায় যেমন টুপি দেখা যায়, অনেকটা ঠিক তেমনই। ওটাই তাঁদের একমাত্র ইউনিফর্ম। বাকিটা যে যেমন থাকেন, তেমনই। না, সেনাবাহিনী বা পুলিশের কেউ নন ওঁরা। তবে কাজটা তাঁদের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। পাচার থেকে শুরু করে পারিবারিক হিংসা বা মদ খেয়ে এসে উৎপাত, এসব রুখতে একাই একশো তাঁরা। উত্তরপ্রদেশের সেই গুলাব গ্যাংয়ের কথা ভোলেননি নিশ্চয়ই। অনেকটা তাঁদের ঢংয়েই কাজ করে চলেছেন ছত্তীসগঢ়ের বালোড জেলার এই প্রমীলাবাহিনী।
আরও শুনুন: কন্যাসন্তান জন্মালেই রোপণ ১১১টি চারা গাছ, কোথায় পালিত হয় এই প্রথা?
‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করার অধিকার’ কে আর কবে হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছে। তাই অধিকার ছিনিয়ে নিতে সবসময়েই লড়াই করতে হয়েছে মেয়েদের। আর সেই লড়াইয়ের প্রথম পদক্ষেপ বোধহয় শিক্ষা। আর সেই কাজটাই করে ছিলেন ছত্তীসগড়ের সমাজকর্মী সামশের বেগম। পিছিয়ে পড়া, অনগ্রসর শ্রেণীকে শিক্ষার আলোয় টেনে আনতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পদ্মশ্রী বিজয়ী সামশের। ২০০৬ সালে তাঁরই উদ্যোগে তৈরি হয় ‘মহিলা কম্যান্ডোজ’। বাড়িতে গার্হস্থ্য হিংসার শিকার কিংবা মদ্যপ স্বামীর অত্যাচারে দিশেহারা মেয়েদের একত্রিত করা শুরু করলেন সামশের। দেখতে দেখতে দলের সদস্যপদ ছাড়াল একশোর কোঠা। তাঁদের মধ্যে কেউ পাচার হতে হতে বেঁচেছেন, তো কেউ অন্য কোনও ভাবে সামাজিক আশ্রয় পেতে মরিয়া। তাঁরা যা সহ্য করেছেন, তার আঁচ যেন এসে না পড়ে তাঁদের সন্তান বা পরবর্তী প্রজন্মের গায়ে। এই ভাবনা থেকেই শুরু হয়েছিল লড়াইটা।
সেই একশো জনের দল আজ বাড়তে বাড়তে ছাড়িয়েছে ১৫ হাজারের গন্ডি। আশপাশের অন্তত ৩০টি গ্রামের মেয়েরা শামিল হয়েছেন শামসেরের সঙ্গে। এমনকী প্রশাসনের তরফেও মিলেছে স্বীকৃতি। আপাতত ছত্তীসগঢ় পুলিশের একটি শাখা হিসেবে গণ্য হয় ‘সুপার পুলিশ কম্যান্ডোজ’ তথা প্রমীলা বাহিনীর এই দল। গার্হস্থ্য হিংসা বা মদ্যপদের তাণ্ডব, পণপ্রথা, মানবপাচার এমনকি বেআইনি ভাবে মদ ও মাদক বিক্রি রুখতেও সদা সচেষ্ট তাঁরা। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গ্রামের বিভিন্ন অংশে নিয়মিত টহল দেয় প্রমিলাবাহীনী। কোথাও কোনও অন্যায় দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। মাদকাসক্তদের কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও তাঁরা তুলে নিয়েছেন নিজেদের কাঁধে।
আরও শুনুন: পুরুষদের কাজ আবার কী! বাড়ির বাধা উড়িয়ে গাড়ির মেকানিক হয়েই স্বপ্নপূরণ তরুণীর
২০১৬ সালে এই প্রমীলা বাহিনীর জন্য বিশেষ পদের ব্যবস্থা করেন বালোড পুলিশের সুপারিনটেনডেন্ট আরিফ হুসেন শেখ। প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে দশ জন করে মহিলাকে বেছে নিয়ে একটি কোর টিম তৈরি করেছিলেন তিনি। তাঁদের নেতৃত্বে চলত কাজ।
না, এ কাজের জন্য আলাদা করে কোনও বেতন পান না তাঁরা। তবে সমাজের প্রয়োজনে এই নজরদারী চালিয়ে যাচ্ছেন শামশেরের বাহিনী। অপরাধী ধরা কাজ নয় তাঁদের। বরং সামাজিক অসুরদের বধ করে সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ‘মহিলা কম্যান্ডোজ’।