সম্প্রতি দিল্লির এক ব্যক্তি প্রশ্ন তুলেছেন, ভারতীয় প্রেক্ষাপটে ‘ডিশওয়াশার’-এর ব্যবহার বহুল প্রচলিত হল না কেন? নেপথ্যে কি রয়েছে কেবলমাত্র ইলেকট্রিক চালিত গ্যাজেট ব্যবহারের প্রতি ভারতীয়দের অনীহা? নাকি প্রছন্ন পুরুষতান্ত্রিকতা?
“আমাদের দেশভর্তি এত ইঞ্জিনিয়ার, তবুও কেউ একটা মিক্সার-গ্রাইন্ডার আবিষ্কারের কথা ভাবেনি। শিলনোড়ায় মশলা বাটতে বাটতে আর্থারাইটিস-এর যন্ত্রণায় দিদিমার যাই-যাই অবস্থা, দাদু তবু জানিয়ে দেন, শিলনোড়ায় বাটা মশলা দিয়ে তৈরি রান্না না হলে তিনি তা ছোঁবেনই না!”- এ কথা কে বলেছিলেন মনে পড়ছে? হ্যাঁ, কুণাল কামরা। যাঁর বক্তব্যের রাজনৈতিক ইঙ্গিত নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই, সেই ভিডিও-তেই কিন্তু তিনি এমন জরুরি প্রসঙ্গের অবতারণাও করেছিলেন। রাজনীতির চাপান-উতোরে তা খড়কুটো হয়ে গেলেও, এ-প্রসঙ্গ কিন্তু ভুলে যাবার নয়।
সম্প্রতি দিল্লির এক ব্যক্তির প্রশ্নে সেই প্রায় হারিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গটিকে আর একবার ফিরে দেখা যেতে পারে। ওই ব্যক্তির প্রশ্ন, ভারতীয় প্রেক্ষাপটে ‘ডিশওয়াশার’-এর ব্যবহার তেমনভাবে হতে দেখা যায় না কেন?
সে উত্তরে যাওয়ার আগে, সাম্প্রতিক একটি সিনেমাতেও চোখ বুলিয়ে নেওয়া যায়। মাসকয়েক আগে মুক্তি পেয়েছিল সানিয়া মালহোত্রার ছবি ‘মিসেস’। যেখানে দেখা যায়, মিক্সি-তে তৈরি চাটনি মুখে তুলতে চান না শ্বশুরমশাই। কেবল তাঁর মন রাখতে ও পরিবারের বাকিদের কাছে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে সানিয়া মালহোত্রা অভিনীত চরিত্রটি শিলনোড়ায় মশলা বাটতে যায়। বাকি সমস্ত রকমের গৃহকর্মও করে চলে প্রাণপাত করে। যদিও এরপরে যে সে কেবল নিজের শ্রমের মূল্য পায় না, তাই-ই নয়, সে ছেড়ে যাওয়ার পরে নির্দ্বিধায়ে নতুন বউ ঘরে আনতে দেখা যায় রিচার প্রাক্তন স্বামী দিবাকরকে। মজার বিষয় হল, যে একটিমাত্র দৃশ্যে নতুন মেয়েটিকে দেখতে পাওয়া যায়, সেখানেও সে রিচার মতোই নতমতস্কে সদ্য তাওয়া থেকে নামানো রুটি নিয়ে এগিয়ে আসে ডাইনিং টেবিলের কাছে। যেখানে বরাবরের মতো খাবার পরিবেশিত হওয়ার জন্য অপেক্ষায় বসে রয়েছে দিবাকর ও তার বাবা। অর্থাৎ, পুরুষকে নারীর পরিষেবা দিয়ে চলার চিরাচরিত ‘লুপ’ অক্ষুণ্ণ রয়ে যায়। বলা বাহুল্য, মালায়ালাম ছবি ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’ অবলম্বনে তৈরি এই সিনেমাটি ঘিরেও কম বিতর্ক হয়নি।
এই প্রেক্ষিতেই ফেরা যাক কুণাল কামরার বক্তব্যে। কেবল মিক্সার নয়, কুণাল কামরা বলেন, ওয়াশিং মেশিন, ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ প্রভৃতি নানারকমের ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের কথা, যার প্রতিটিই গৃহস্থ বাড়িতে মেয়েদের কাজ সহজ করে, এবং যার প্রায় সবকটি নিয়েই অভিযোগের শেষ থাকে না পরিবারের পুরুষ সদস্যদের। অপরদিকে, যেসব ইলেকট্রনিক গ্যাজেট কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের কাজ সহজ করে, তা সে কম্পিউটার-প্রিন্টার হোক, বা কারখানার কলকব্জা, তার আবিষ্কার হয়েছে তৎপরতার সঙ্গে। কুণাল কামরা কৌতুক করে বলেন, সামাজিক মাধ্যমে জনপ্রিয় হওয়া যে মিম-টিতে দেখা যায় যে অ্যারেঞ্জড ম্যারেজের পর ফুলকো গোল রুটি খেতে পাওয়া যায়, আর লাভ ম্যারেজের ফলস্বরূপ পুড়ে তেতো হয়ে যাওয়া রুটি, সেখানেও ইঙ্গিত মেয়েদের গৃহশ্রমের পারিদর্শিতার দিকেই। লাভ ও অ্যারেঞ্জড ভেদে স্বামীর আচরণে তফাৎ হয় কি-না, তা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতে দেখা যায় না কাউকে।
এসব আলোচনায় নতুনত্ব কিছু নেই। বাড়ির কাজ ও বাইরের কাজে নারী-পুরুষ তকমা সেঁটে দেওয়া চলে কি-না, তা নিয়ে বিবাদ চলেছে বহুকাল ধরে। প্রতিবারের বিবাদে যদি নতুন কোনও তথ্যের উপস্থাপনা হতে দেখা যায় তবুও, সমাধান কিছুই মেলে না।
সম্প্রতি দিল্লির ওই ব্যক্তি প্রায় একই প্রশ্ন তুলেছেন। ভারতীয় প্রেক্ষাপটে ‘ডিশওয়াশার’-এর ব্যবহার বহুল প্রচলিত হল না কেন? উত্তরে নেটদুনিয়ায় বিবিধরকমের থিওরি। কেউ বলেন, ভারতীয়রা কোনোকালেই প্রযুক্তির অগ্রগতিকে মুক্তমনে আহ্বান জানাতে পারেনি। আর তার জন্য, কেবল এক্ষেত্রে নয়, সবক্ষেত্রেই উন্নয়ন পিছিয়ে থেকেছে। অপরদিকে, চিন বা জাপানের মতো দেশে, দৈনন্দিন কাজকে সহজ করতে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে চলে গ্যাজেটের ব্যবহার, তাতে সামাজিক অগ্রগতির পথও প্রশস্ত হয়েছে। এ-দেশে তেমনটা দেখা যায় না। নেটিজেনদের কেউ কেউ বলছেন, ভারতের অনেক জায়গাতেই এখনও ইলেকট্রিসিটি পৌঁছায়নি। যাদের কাছে রাতের বেলায় আলো অথবা পাখা চালানোর সামর্থ্যটুকু নেই, তাদের কাছে অন্যান্য ইলেকট্রিক-চালিত গ্যাজেট ব্যবহার প্রশ্নাতীত। তবে স্বাভাবিকভাবেই এই মতকে সম্পূর্ণ সমর্থন জানানো চলে না। কারণ একটু খেয়াল করলেই আমরা দেখব যে, ভারত যখন ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ অথবা ওয়াশিং মেশিন ব্যবহার বাড়ানোর কাজে কোমর বেঁধেছে, তা সবসময়েই কেবলমাত্র সেইসব জনগণের কথা মাথায় রেখে, যারা এগুলি পয়সা খরচ করে কিনতে পারবে ও ইলেকট্রিকের সাহায্যে চালাতে পারবে।
আর এইখানেই ওঠে আরও একটি নতুন প্রশ্ন, যা আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় একেবারে তর্কের গোড়ার কথায়। দিল্লির যুবকটিকে উত্তরে একাংশ বলেন যে ভারতীয় অর্থনৈতিক পটভূমিতে গৃহস্থ পরিবারগুলির পক্ষে মোটা টাকায় ডিশওয়াশার কেনার চাইতে, স্বল্প মাইনেতে গৃহসহায়িকা রাখা অনেক লাভদায়ী, যার কাজ কেবল বাসন মাজায় সীমাবদ্ধ থাকবে না। গৃহসহায়িকা – সেইসব শ্রমজীবী নারী, যারা বাড়ির কাজ শেষ করে অন্যের বাড়িতেও ঘরের কাজ করতেই যান। তবে কি কেবল ইনফিনিটি লুপ-এ ঘুরে চলা ছাড়া এহেন প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত কোনও উত্তর খোঁজা নিরর্থক? কুণাল কামরা-র পোস্টটির কমেন্টবক্সে যত্নসহকারে এটুকু অংশ এড়িয়ে যান দর্শক-শ্রোতারা। অন্যদিকে ‘মিসেস’ মুভি প্রসঙ্গে পুরুষেরা খুঁজে নিয়ে আসেন হাতে-গোনা কিছু পুরুষ নির্যাতনের ঘটনার উদাহরণ। বাস্তবে দেখা যায়, নিজেকে খেটে করতে হলেও বা আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল হলেও বাড়ির বহু মহিলাই গ্যাজেট ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করেন।
তবে কি আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে শ্রম সহজ করার পথে প্রাথমিক বাধা আর্থিক সামর্থ্য নয়, চিরাচরিত মজ্জাগত পুরুষতান্ত্রিকতা? সওয়াল রয়েই যায়!