সময় পাল্টেছে। মেয়ে মানেই নরম-সরম, আতুপুতু। ভারী, শক্ত কাজ তাঁদের জন্য নয়। এসব বলার সময় শেষ। অন্তত সে ব্যাপারটাই বারবার প্রমাণ করে দিচ্ছেন আজকালকার মেয়েরা। মধ্যপ্রদেশের এই কন্যাও কম যান না কিছুতে। ছক ভেঙে তিনি হয়ে উঠেছেন তাঁর গ্রামের প্রথম গাড়ির মেকানিক। আসুন, শুনে নিই তাঁর কথা।
মস্ত বড় বড় সব বাইক-গাড়ি, জটিলতর তার কলকব্জা। আর সেসব অবলীলায় সারিয়ে ফেলছে এক তরুণী। এ দৃশ্যটা বোধহয় সচরাচর দেখা যায় না। বিশেষত সেটা যদি মধ্যপ্রদেশের কোনও এক প্রত্যন্ত গ্রাম হয়। তবে সেই ধরাবাঁধা ছকটাই ছোট থেকে ভাঙতে চেয়েছিলেন ইন্দ্রাবতী ওয়ারকাড়ে। আজকে দাঁড়িয়ে কোনও কাজের ক্ষেত্রেই যে লিঙ্গবৈষম্যটা কোনও ব্যাপার নয়, তা-ই প্রমাণ করে দিতে চেয়েছেন ইন্দ্রাবতী।
আরও শুনুন: এককালে শিকার হয়েছিলেন গৃহহিংসার, এখন তিনিই পুলিশ হয়ে পথ দেখাচ্ছেন নির্যাতিতাদের
ছোট থেকে বাইকের শখ ছিল তাঁর। সেই শখটা অবশ্য এসেছিল দাদা মনোজের কাছ থেকেই। দাদার কাছেই প্রথম হাতেখড়ি বাইক চালানোয়। কোথাও গেলেই ইন্দ্রাবতীকে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যেতেন মনোজ। বাইক চালানোর খুটিনাটি যত্ন করে বুঝিয়ে দিতেন বোনকে। তবে সেই দাদার আচমকা মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছিল ইন্দ্রাবতীকে। পারিবারিক অবস্থা খুব সচ্ছল বললে ভুল বলা হবে। বাবা-মা কোনওমতে চাষের কাজ করে সংসার চালাতেন। সেভাবেই বিজ্ঞানে স্নাতক পাশ করেন ইন্দ্রাবতী।
দাদার আচমকা মৃত্যুতে কিনারায় গিয়ে দাঁড়াল সংসারটা। ইন্দ্রাবতীর পরে ছোট ভাই রয়েছে। তাঁর পড়াশোনা তখনও বাকি। তাছাড়া রয়েছে সংসারের বাকি খরচপাতিও। বাধ্য হয়েই সংসারের জোয়াল নিজের কাঁধে তুলে নিলেন ইন্দ্রাবতী। তবে ছক ভাঙার ইচ্ছা থেকে সরলেন না মোটেই।
যে গ্রামে মেয়েদের স্নাতক পাশ করাটাই রীতিমতো একটা চ্যালেঞ্জ, সেখানে মেকানিক হওয়ার কাজটা সহজ কথা যে ছিল না তাঁর জন্য। তবে সেটাই করে দেখিয়েছেন ইন্দ্রাবতী। প্রফেশনাল অ্যাসিসট্যান্স ফর ডেভলপমেন্ট অ্যাকশন নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সংস্পর্শে এসেই বদলে যায় তাঁর জীবন। গ্রামীণ যুবসম্প্রদায়ের জন্য একটি বিশেষ কারিগরী বিদ্যা শেখানোর ব্যবস্থা করেছিল স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। যেখানে নিজের পছন্দের বিষয়ে শেখার সুযোগ পান ইন্দ্রাবতী।
বরাবরই বাইক নিয়ে আগ্রহ তাঁর। সেই প্রোগ্রামের আওতায় তিনি পড়তে শুরু করলেন মোটর ভেহিক্যাল নিয়ে। হয়ে উঠলেন সেই গ্রামের একমাত্র মহিলা মেকানিক। গ্লাস সিলিং ভাঙা থেকে শুরু করে নানা ধরনের ভারী কাজ করতে হয় এই পেশায়, যা সাধারণ ভাবে পুরুষদের কাজ বলেই মনে করা হয়ে এসেছে এতদিন। তবে সেই স্টিরিওটাইপটাকেই অবলীলায় ভেঙেছেন ইন্দ্রাবতী।
আরও শুনুন: প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন খোদ মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে, প্রথম পেশাদার গোয়েন্দা এই মহিলাই
বাধা এসেছে পরিবারের দিক থেকেও। প্রাথমিক ভাবে মেয়ের মেকানিক হওয়ার ব্যাপারেও আপত্তিই জানিয়েছিলেন তাঁর বাবা। তবে সে ব্যাপারে ইন্দ্রাবতী পাশে পান তাঁর মাকে। ৬ মাসের প্রশিক্ষণ শেষে জব্বলপুরের একটি ওয়ার্কশপে মেকানিকের চাকরি পান তিনি। ইতিমধ্যেই মেকানিক হিসেবে ভালই নামডাক হয়েছে ইন্দ্রাবতীর। পাশে দাঁড়িয়েছেন পরিবারেরও। শুধু তাঁর গ্রামেরই নয়, আজ গোটা মধ্যপ্রদেশের গর্ব এই কন্যা।
না, তবে এখানেই থামতে চান না ইন্দ্রাবতী। আরও বড় স্বপ্ন রয়েছে যে তাঁর। অন্যের ওয়ার্কশপে চাকরি তো অনেক হল। এবার নিজের একটি ওয়ার্কশপ খুলতে চান ইন্দ্রাবতী। যেখানে দু-চাকা যানবাহন সারাইয়ের কাজ হবে। ইন্দ্রাবতীর মতোই এই পেশায় এগিয়ে আসুক আরও মেয়েরা। সেই উৎসাহটাই জোগাতে চান ইন্দ্রাবতী। তাঁর সেই ওয়ার্কশপে তাঁরই মতো আরও অনেকে মেয়েরা কাজ করবেন। বড় মেকানিক হওয়ার স্বপ্ন দেখবেন, তেমনটাই আশা মধ্যপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে ইন্দ্রাবতী।