সম্পর্কে রবি ঠাকুরের ভাগ্নি হলেও, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাসের সঙ্গেও অনেকসময়ই মত মেলেনি সরলার। মেলাতে চানওনি তিনি। বরং বরাবরই, নিজের লিঙ্গপরিচয়কে মাথায় রেখেই তিনি নিজস্ব স্বর খুঁজতে চেয়েছেন। মেয়েদের লড়াইয়ে তাঁর সেই পাঠের গুরুত্ব কমেনি আজও।
মেয়েদের সমস্যা, মেয়েদের বিপন্নতা নিয়ে যদি কথা বলতে হয়, তা মেয়েদের মতো করে আর কে বলতে পারবেন? অথচ দেখা যায়, সেখানেও সামনে আসতে চান পুরুষেরাই। তাঁরাই মেয়েদের হয়ে কথা বলতে চান। আবার মেয়েদের বিপন্নতাকে কতখানি গ্রাহ্য করা হবে বা হবে না, সেই দাঁড়িপাল্লাও তাঁরাই ধরে রাখতে চান। সম্প্রতিই মেয়েদের রাত দখল তথা অধিকার দখলের ডাকে পুরুষদের প্রবেশ নিয়ে এ কথাই উঠেছিল। আর এই কথাই বহু বছর আগে বলে গিয়েছিলেন আরেক নারী। মেয়েদের অধিকারের রাজনীতি থেকে রাজনীতিতে মেয়েদের অধিকার, সমস্ত কিছুর প্রেক্ষিতেই। ঠাকুরবাড়ির মেয়ে, স্বর্ণকুমারীর কন্যা আর রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নি সরলা দেবী চৌধুরাণী আত্মজীবনী ‘জীবনের ঝরাপাতা’-য় সপাটে বলতে ছাড়েননি, “রাজনীতি এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে কোন পুরুষ কোন মেয়ের জন্য সিট ছাড়তে পরাঙ্মুখ, সবই আপকে ওয়াস্তে— তাই অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি থেকে শুরু করে বেঙ্গল কৌন্সিল অ্যাসেম্বলি পর্যন্ত মেয়েদের জন্য গুটিকত আলাদা সিট নির্ধারিত করা হয়েছে, সেই কটি দখলের জন্য মেয়েরা পরস্পরের সঙ্গে যত চাও লড়াইদাঙ্গা, আঁচড়াআঁচড়ি কামড়াকামড়ি কর তাতে পুরুষের আপত্তি নেই…। কিন্তু মেয়েরা যদি পুরুষ দেবতাকেই বলে বসেন, ‘তোমার সিংহাসনটাই আমায় ছেড়ে দাও না ভাই’— তা হলেই বিপদ, তা হলেই পুরুষের পৌরুষ বেরিয়ে পড়ে চোখ রাঙা করে বলে, ‘কভি নেই’।”
আরও শুনুন:
নির্যাতনের দামে কেনা, তাই খোলা আকাশের অধিকার মেয়েদেরও
সম্পর্কে রবি ঠাকুরের ভাগ্নি হলেও, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাসের সঙ্গেও অনেকসময়ই মত মেলেনি সরলার। মেলাতে চানওনি তিনি। বরং বরাবরই, নিজের লিঙ্গপরিচয়কে মাথায় রেখেই তিনি নিজস্ব স্বর খুঁজতে চেয়েছেন। ১৯৩১ সালে কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনের পাশাপাশি মহিলা কংগ্রেস নেত্রীদের অধিবেশন হয়েছিল। সেখানে সরলা বলছেন, কেবল আইনভঙ্গের আন্দোলনে মেয়েদের ডাক পড়ে, আইন তৈরি করার সময় কাউন্সিল হল, কমিটি, সাব-কমিটির পদগুলো ছেলেদের দিয়ে ভরা হয়। রাজনৈতিক দলগুলি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির অধিকারের পক্ষে কথা বলে, সব শ্রেণির সমানাধিকারের পক্ষেও সওয়াল করে কেউ কেউ; অথচ নারী আর পুরুষও যে দুটি পৃথক শ্রেণি আর সেক্ষেত্রেও সমানাধিকার প্রয়োজন, সে কথা ওঠে না প্রায়। আজকের দিনেও যে মানসিকতা জগদ্দল পাথরের মতোই দাঁড়িয়ে আছে, সেই মানসিকতাকে প্রায় একশো বছর আগেই বিদ্রুপ করে সরলা বলছেন, কংগ্রেসকে কত না ঠেলা দিয়ে চাষি ও মজুরদের অধিকার সনদ ঘোষণা করেছেন পণ্ডিত নেহরু। এ দিকে যারা জনসংখ্যার অর্ধেক, সেই মেয়েরা প্রতীক্ষায় আছে এক ‘পণ্ডিতানীর’ যিনি কংগ্রেসকে আর একটু ঠেলে মেয়েদের অধিকারের সনদটা বার করবেন।
মেয়েদের মৌলিক অধিকারের তালিকায় রাজনৈতিক অধিকারের কথাও রেখেছিলেন বইকি সরলা। আইনসভা, পুরসভা থেকে লিঙ্গবৈষম্যের জন্য মেয়েরা যাতে বাদ না পড়ে, তা নিশ্চিত করার কথা বলেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের দাবি মেয়েদের ‘মৌলিক অধিকার’। পাশাপাশি, মেয়েদের ‘মৌলিক কর্তব্য’ কী কী, সেই তালিকায় সরলা রেখেছিলেন, ‘রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা বর্জন’। মাত্র কয়েকজন মেয়ে রাজনীতি করবে, এমন নয়। প্রতিটি মেয়ে সক্রিয় হবে রাজনীতিতে। নারীর অধিকার বুঝে নিতে মেয়েদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ যে কতখানি জরুরি, সে কথা বুঝেছিলেন সরলা। কেননা তিনি তো জানতেন, সামাজিক পারিবারিক ক্ষেত্রেও মেয়েদের পাওয়া না-পাওয়া কোনও কিছুই মেয়েদের ভোট নিয়ে ঠিক হয় না। ‘নারী-মন্দির’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন— “মনুর সময় হইতে আরম্ভ করিয়া অদ্যাবধি ঘরে বাহিরে যাহা কিছু অধিকার নারী পাইয়াছেন, তাহা কেবল পুরুষদের আরাম ও সুবিধাকল্পে, নারীর দিক ভাবিয়া নহে।” ঘরেই যখন এই অবস্থা, বাইরে তার ব্যতিক্রম হবে কেন! সুতরাং জাতীয় রাজনীতিতে মেয়েদের অপ্রাপ্তির কথা পৌঁছতে হলে, সামগ্রিকভাবে দেশের নারীদের অবস্থায় পরিবর্তন আনতে হলে, রাজনীতির মঞ্চ থেকে মেয়েদেরই কথা বলতে হবে, সরলা বুঝেছিলেন। প্রথম সর্বভারতীয় নারী সংগঠন, ‘ভারতীয় স্ত্রী মহামণ্ডল’ প্রতিষ্ঠা করেন তিনিই, ১৯১০ সালে। সেই সময়ে চল্লিশ বছরের সরলা মনে করতেন, “দ্য উইমেন্স কজ ইজ দ্য মেনস কজ”, অর্থাৎ মেয়েদের লড়াইয়ে পুরুষদের শরিক হওয়াকে তিনি অস্বীকার করতে চাননি। কিন্তু আরও বছর কুড়ি পেরিয়ে, ষাটের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে সেই সরলা কংগ্রেসের মহিলা অধিবেশনে বলছেন, পুরুষরা মেয়েদের অনুগ্রহের পাত্র বলে মনে করে, তাই পুরুষের পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাখ্যান করতে হবে মেয়েদের।
আরও শুনুন:
হিজাব বিতর্কের ভারতবর্ষে মনে থাকুক ‘অবরোধবাসিনী’দের হয়ে বেগম রোকেয়ার লড়াই
পিতৃতন্ত্র মেয়েদের কীভাবে রুখে দিতে চায়, সে কথা বুঝেছিলেন সরলা দেবী। ঘরে আর বাইরে, সমাজে আর রাজনীতিতে, সর্বত্রই তার মোকাবিলা করার কথাও তিনি শিখিয়েছিলেন। মেয়েদের লড়াইয়ে সে পাঠের গুরুত্ব কমেনি আজও।