যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম চিঠি। সেটাও বন্ধ হলে হারিয়ে যাবে গ্রাম। তাই হাজারও প্রতিকূলতা পেরিয়ে রোজ চিঠি কিংবা পার্সেল পৌঁছে দেন উলফত। কাশ্মীরের প্রত্যন্ত গ্রামে তিনিই একমাত্র মহিলা ডাক হরকরা। কিন্তু কীসের টানে এমন ঝুঁকি নেন বছর ৫৫-র মহিলা? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
চারদিকে বরফ। সাদা ধবধবে। কোথাও জনমানব নাই। বরফের চাদর এতটাই পুরু যে, অনায়াসে ঢেকে যাবে দু-তিনজন। অথচ সেই পথ পেরিয়ে রোজ একা হেঁটে যান বছর পঞ্চান্ন এই মহিলা। উদ্দেশ্য, চিঠি আর পার্সেল পৌঁছে দেওয়া।
:আরও শুনুন:
৭০-এ সংস্থা খুলে চাকরি ৬ জনকে, খুঁজছেন আরও লোক, প্রেরণার নাম চন্দ্রপ্রভা
কথা বলছি, উলফত বানো সম্পর্কে। পেশায় ডাক হরকরা। কাশ্মীরের প্রত্যন্ত গ্রাম হিরপোরা তাঁর কর্মক্ষেত্র। সহকর্মী মাত্র একজন। তিনি অবশ্য পুরুষ। ডাক অফিসের যাবতীয় কাজকর্ম দুজনকেই সামলাতে হয়। আকারে আয়তনে খুব একটা ছোট নয় এই গ্রাম। তাই মোটের উপর চিঠি বা পার্সেল আসতেই থাকেই। তবে সমস্যা অন্য জায়গায়, তা হল এই গ্রামের প্রতিকূল পরিবেশ। বছরভর এখানে বরফ থাকে। শীতকালে তা মাত্রা ছাড়ায়। সাধারণ কারও পক্ষে এখানে শীতকালে দিন কাটানো প্রায় অসম্ভব। তাই পর্যটকরাও খুব একটা এই গ্রামে পা রাখেন না। খাবার থেকে শুরু করে জল, সবরমকের সমস্যায় গ্রামের বাসিন্দাদের ভুগতে হয় শীতের সময়। পাইপের ভিতরেও বরফ জমে যাওয়ায় পানীয় জলটুকু পেতেও নাকাল হন অনেকে। স্রেফ একটা বিষয় নিয়ে এঁদের কোনও ভাবনা নেই। তা হল, ডাক ব্যবস্থা। যতই শীত আসুক, বরফ পড়ুক, সবার ঘরে ঘরে সময়মতো চিঠি পৌঁছে যাবেই। সৌজন্যে উলফত। নিজেই চিঠি বা পার্সেল পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেন এই মহিলা। আর এভাবেই নাকি ৩০ বছর কাটিয়ে ফেলেছেন ইনি।
:আরও শুনুন:
কর্মরতাদের সুবিধায় নতুন নীতি অন্ধ্রপ্রদেশে, তবু কর্মরতাদের কি পছন্দ করে ভারতীয় সমাজ?
মনে হতেই পারে এই কাজের জন্য বিশেষ কোনও পুরস্কার বা বাড়তি টাকা পান উলফত! তবে সত্যিটা একেবারেই তা নয়। মাস গেলে সামান্য কটা টাকাই বেতন হিসেবে পান। যেহেতু সরকারি চাকরি তাই বেতনের মান এক। অর্থাৎ সমতলের কোনও ডাককর্মী যার পদ উলফতের সমান, তিনি যা টাকা বেতন পান উলফতও সেই একই টাকা পান। তাই বলে কাজে এতটুকু ফাঁক রাখেন না। বরং অন্য অনেকের তুলনায় অনেকটা বেশি পরিশ্রম করেন। পরিবারের সহযোগিতা না থাকলে এমনটা হয়তো সম্ভব হতো না, একথা উলফত নিজেও মনে করেন। স্বামী প্রাক্তন ডাককর্মী হওয়ায় বাড়তি সুবিধাও হয়েছে তাঁর। তাই বাড়ি নিয়ে আলাদা করে ভাবতে হয় না। সারাদিনে অন্তত ২০-২৫ টা চিঠি বা পার্সেল পৌঁছে দেন উলফত। তবে সবটাই পায়ে হেঁটে। এমনিতেই বরফে গাড়ি চালানো কঠিন, তার ওপর উলফত গাড়ি চালাতে জেনেন না। এমনকি সাইকেলও না। তাই কষ্ট করে হলেও পায়ে হেঁটে পাহাড়ের গ্রামে হাজির হন রোজ। সবথেকে সুবিধা হয় ওই গ্রামের পড়ুয়াদের। পড়ার বই কিংবা ওই সংক্রান্ত যাবতীয় জিনিসপত্র উলফতের মাধ্যমেই তাঁদের হাতে এসে পৌঁছয়। আসলে, আজকের দিনে দাঁড়িয়েও ওই গ্রাম ডিজিটাল হয়ে উঠতে পারেনি। তাই চিঠিই হল বর্হিবিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। সেটিও প্রকৃতির প্রতিকূলতায় বন্ধ হয়ে গেলে আঁধার নেমে আসবে গ্রামে। এমনটা কখনও হতে দিতে চান না উলফত। আর সেই কারণেই নিরলস পরিশ্রম সত্ত্বেও গ্রামের মানুষকে আশার আলো দেখিয়ে চলেছেন তিনি।