‘নন্দর মা কি দুলালী, না প্রিয়বালা?’ কবিতায় এক উদ্বাস্তু মহিলার কাহিনি তুলে ধরতে গিয়ে এই প্রশ্ন রেখেছিলেন কবি জয় গোস্বামী। এক দেশ থেকে আরেক দেশ, এক সংসার থেকে আরেক সংসারে ঘুরতে ঘুরতে নিজের আসল নামটাই হারিয়ে গিয়েছে যার। ছেলে নন্দর নামের সূত্রেই এখন তার পরিচয়। এমনটাই তো ঘটে এ দেশের আরও অনেক মেয়ের সঙ্গে। কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশের প্রত্যেকটি মানুষের যে নিজস্ব পরিচয় প্রাপ্য, ভারতের প্রথম নির্বাচন সে কথাই মনে করিয়ে দিয়েছিল। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
গণতন্ত্রের উৎসব হল নির্বাচন। আর তাই নির্দিষ্ট সময় অন্তর দেশে বেজে ওঠে ভোটের বাদ্যি। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই প্রক্রিয়াতে অবাক হওয়ার হয়তো বিশেষ কিছুই নেই। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে তার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলার কাজটা সহজ ছিল না। কারণ নির্বাচন কী, সে বিষয়ে কোনও ধারণাই ছিল না সাধারণ মানুষের মধ্যে। প্রথমবার নির্বাচন করানোর সময় তাই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বও ছিল আরও অনেক বেশি। আর এই দুয়ের যোগফলেই এমন একটি কাণ্ড ঘটেছিল, যার দরুন দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশই নিতে পারেননি অন্তত ২৮ লক্ষ মহিলা।
আরও শুনুন: সদ্যোজাত সন্তানের মৃত্যুতেই সিদ্ধান্ত, দেশের প্রথম মহিলা চিকিৎসক হয়েছিলেন আনন্দীবাই
গণতান্ত্রিক সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেখানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের ভোট সমান গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে এমন বিপুলসংখ্যক ভোটারের ভোট দিতে না পারার কারণ কী?
আসলে এর জন্য দায়ী ছিলেন ভারতের প্রথম নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন। তাঁর কাজ যে কতখানি কঠিন ছিল, সে কথা বলতে গিয়ে ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ তাঁর ‘ইন্ডিয়া আফটার গাঁধী’-তে লিখেছেন, “একুশ বছর বা তার বেশি বয়সের ১৭ কোটি ৬০ লক্ষ ভারতীয় ভোট দেবে, তার মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ পড়তে বা লিখতে জানে না। প্রত্যেকটি ভোটারকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে হবে, নাম লিখে নথিভুক্ত করতে হবে।” কিন্তু কার নাম লেখা হবে? ভোটার তালিকা তৈরির সময় দেখা গেল, অনেক মহিলাই নিজের নাম বলতে রাজি নন। অমুকের মা, কিংবা তমুকের স্ত্রী, এই পরিচয় নিয়েই ভোট দিতে চান তাঁরা। এই বিষয়টিকে অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছিলেন ভারতের প্রথম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার। অমুকের মা বা স্ত্রীর পরিচয়-লেখা ভোটারদের তিনি তালিকা থেকেই বাদ দিয়েছিলেন। পরবর্তী নির্বাচনে অন্তত ভোট দেওয়ার জন্য এই কুসংস্কার কিছুটা কাটবে, এমনটাই যুক্তি ছিল সুকুমার সেনের।
আরও শুনুন: দেবদাসী হওয়ার ভাগ্যলিপি বদলে হলেন চিকিৎসক, দেশের প্রথম মহিলা বিধায়ক তিনিই
আসলে এ দেশের অধিকাংশ মেয়ের নিজের পরিচয় তো এভাবেই হারিয়ে যায়। সেই যে মনু ঋষি বলেছিলেন, মেয়েরা বাল্যে পিতা, যৌবনে স্বামী আর বার্ধক্যে পুত্রের সম্পত্তি; মেয়েদের সেই ‘সম্পত্তি’ বলে গণ্য করার অভ্যাস এখনও জারি রয়ে গিয়েছে সমাজের অনেক স্তরেই। আধুনিক দুনিয়াতেও স্রেফ মিসেস অমুক বলেই পরিচয় দেওয়ার চল রয়েছে। কারও মা কিংবা স্ত্রীর পরিচয়ের আড়ালে এমনভাবেই ঢেকে যায় নিজের নাম তথা নিজস্ব পরিচয়। অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি কাজকর্মের ক্ষেত্রেও অভিভাবকের নাম জানাতে হয়, এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে তা বাধ্যতামূলকভাবেই বাবা কিংবা স্বামীর নাম। মা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হলেও, তাঁর সন্তানের সবরকম দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও, বাবা বর্তমান থাকাকালীন তাঁর অভিভাবক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পরিস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে। সিঙ্গল মাদার-দের ক্ষেত্রে আইনিভাবে এই স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্র থাকলেও সামাজিকভাবে লড়াই থামেনি। সেও একরকমভাবে মেয়েদের নিজস্ব পরিচয়কে স্বীকার না করারই রাজনীতি। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, এই অস্বীকারের পালটা এক বয়ান নির্মাণ করেছিল স্বাধীন দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন। গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত প্রতিটি মানুষকে স্বীকৃতি দেওয়া। মহিলাদের নিজের নাম ব্যবহার করতে জোর দেওয়ার মাধ্যমে সেদিন পরোক্ষে এই সাম্যকেই স্বীকৃতি দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন।