স্কুল-কলেজ-অফিস-কাছারি নয়, মেয়েদের আসল জায়গা যে ঘরেই, সুযোগ পেলেই সে কথা বুঝিয়ে দিতে কসুর করেন না অনেকেই। মেয়ে মাত্রেই বুদ্ধিহীন, কোনও বড় কাজ করার পক্ষে অযোগ্য, এমন এক ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে এঁদের মনে। অথচ ইতিহাস জানায়, এদেশের বিশাল এবং জটিল সংবিধানটি রচনার পিছনেও রয়েছেন ১৫ জন মেয়ে। কারা তাঁরা? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
গোপালকৃষ্ণ গোখলে একসময় বলেছিলেন, ‘হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে, ইন্ডিয়া থিঙ্কস টুমরো’। হ্যাঁ, চিন্তায়, ভাবনায়, মননে সেদিন এতটাই এগিয়ে ছিল বাংলা। সংবিধান কমিটির মহিলা সদস্যদের নাম-ধাম দেখলেও সেই অগ্রগতির চিহ্ন পাওয়া যায়। একাধিক বাঙালি নারী নির্বাচিত হয়েছিলেন এই কমিটিতে। তাঁদের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা সরোজিনী নাইডুর নাম। তিনি কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি। ভারতের প্রথম মহিলা গভর্নরও। স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে একাধিকবার কারাবাসও করেছেন তিনি।
আরও শুনুন – হাতে লেখা হল সংবিধানের প্রথম কপি, প্রাকৃতিক রঙে সাজিয়ে তুললেন নন্দলাল বসু
সদস্যদের মধ্যে পূর্ণিমা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন কংগ্রেসের এলাহাবাদ কমিটির সম্পাদক। সত্যাগ্রহ এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে গ্রেপ্তার হন তিনি। কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন পূর্ববঙ্গের মেয়ে এবং বিশ্বভারতীর ছাত্রী মালতী চৌধুরীও। অংশ নিয়েছিলেন লবণ সত্যাগ্রহে। আরেক সদস্য লীলা রায় আসামের মেয়ে হলেও কলকাতার বেথুন কলেজের স্নাতক ছিলেন। সরোজিনী নাইডুর মতোই নারীর অধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন লীলা, ১৯৪৭ সালে গঠন করেছিলেন জাতীয় মহিলা সমিতিও।
সংবিধান কমিটির সদস্য ছিলেন লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্স-এর স্নাতক রেণুকা রায়। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিরও সদস্য ছিলেন তিনি।
আরও শুনুন- বাংলা মানে শুধু মিষ্টি দই-রসগোল্লা নয়, বাংলাকে চেনা যায় আত্মসম্মানের গরিমাতেই
দক্ষিণের রাজ্যগুলি থেকেও একাধিক মহিলা নির্বাচিত হয়েছিলেন সংবিধান কমিটিতে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কেরলের আম্মু স্বামীনাথন এবং অ্যানি মাসকারেন। ত্রিবাঙ্কুর স্টেট কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সদস্য অ্যানি স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে বহুবার কারাবাস করেছেন। কমিটিতে ছিলেন কোচিনের মেয়ে দাক্ষায়ণী বেলায়ুধান। ১৯৪৫ সালে কোচিনের লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির সদস্য হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছিলেন এই দলিত নেত্রী। ভোলা যাবে না দুর্গাবাই দেশমুখ-এর কথাও। রাজামুন্দ্রির এই মেয়েটি যখন অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১২। অংশ নিয়েছিলেন লবণ সত্যাগ্রহেও। ১৯৩৬ সালে অন্ধ্র মহিলা সভা গড়ে তুলেছিলেন দুর্গাবাই, মাত্র এক দশকের মধ্যেই যা গোটা মাদ্রাজ শহরের শিক্ষা এবং মানবকল্যাণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিল।
আরও শুনুন – পরমবীর চক্রের নকশা বানিয়েছিলেন এই বিদেশিনী, চেনেন তাঁকে?
সংবিধান কমিটিতে ছিলেন স্বাধীন ভারতের দুই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মহিলা নেতৃত্ব। একজন ভারতের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী সুচেতা কৃপালনী। ১৯৪০ সালে কংগ্রেসের নারী বিভাগের সূচনা হয়েছিল তাঁর হাতেই। অন্যজন খোদ জহরলাল নেহেরুর বোন বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, যিনি প্রথম মহিলা ক্যাবিনেট মন্ত্রীও বটে। কমিটিতে ছিলেন ভারতের প্রথম স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজকুমারী অমৃত কৌর (Kaur)-ও। ভারতের শীর্ষ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান এইমস (AIIMS) ছাড়াও টিউবারকুলোসিস অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া, সেন্ট্রাল লেপ্রসি অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি।
এঁরা ছাড়াও সংবিধান কমিটিতে দেখা মেলে আরও তিন মহিলার। ‘অল ইন্ডিয়া উইমেন’স কনফারেন্স’-এর প্রেসিডেন্ট হংসা জীবরাজ মেহতা, রাজপরিবার ছেড়ে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেওয়া কমলা চৌধুরী এবং কমিটির একমাত্র মুসলমান মহিলা সদস্য বেগম আইজাজ রসুল ভারতের সংবিধান রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
আরও শুনুন – দেশে প্রথম মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা, লড়াইয়ের অপর নাম সাবিত্রীবাই ফুলে
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও, ভারতীয় সমাজে নারী এবং পুরুষের মধ্যে যে একরকম অসাম্য বর্তমান, সে কথা অস্বীকার করার জো নেই। সংবিধান নির্মাণের কমিটির মোট ৩৮৯ জন সদস্যের মধ্যে স্থান করে নিয়েছিলেন ১৫ জন নারী। সংখ্যাটা যথেষ্টই কম, কিন্তু এই অসাম্যের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে এই অংশগ্রহণকে কোনওমতেই ছোট করে দেখা চলে না। দেশের মেরুদণ্ড বলা হয় যাকে, সেই সংবিধান রচনার পিছনে মেয়েদের এহেন ভূমিকা শেষ পর্যন্ত ওই অসাম্যের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ হয়েই থেকে গিয়েছে।