‘আমার নাম নুজুদ। বয়স ১০। এবং আমি বিবাহবিচ্ছিন্ন’। বিশ্বজুড়ে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল এ কথা। বাল্যবিবাহের মতো কুপ্রথার বিরুদ্ধে নিজেই জলজ্যান্ত হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল ১০ বছরের নুজুদ আলি। যার গোটা জীবনটাই দাউদাউ আগুনের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার গল্প। আসুন, শুনে নেওয়া যাক এই লড়াকু মেয়ের গল্প।
যে বয়সে বাচ্চারা হইহই করে স্কুলে যায়, খেলার মাঠে ছোটাছুটি করে, সেই বয়সে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল নুজুদের। যখন তার বয়স মাত্র ৯ বছর। ষোলো ছেলেমেয়ের মধ্যে একজনের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলার সুযোগ পেয়ে তার বাবা বেশ খুশি হয়েছিলেন। তাই ২০০৮ সালে বছর তিরিশের পুরুষ ফায়েজ আলি থামেরের সঙ্গে নুজূদের বিয়ে পাকা করে বসেন তিনি। বিয়ের প্রথম রাতেই নববধূর ওপর স্বামীর অধিকার প্রয়োগ করতে উদ্যত হয় ওই পুরুষটি। প্রাণের ভয়ে পালাতে চায় নুজুদ। কিন্তু কোথায় পালাবে? না শ্বশুরবাড়ি, না বাপের বাড়ি, স্বামীর কথা না শুনলে কোথাও ঠাঁই নেই তার। সে তো একা নয়, সে দেশের সব মেয়েদেরই এমনই নিয়তি।
আরও শুনুন: মণিপুর থেকে কান… কেন নগ্নতাকেই প্রতিবাদের হাতিয়ার করে তোলেন নারীরা?
হ্যাঁ, মধ্যপ্রাচ্যে মেয়েদের কপালে ঠিক কতটুকু সম্মান জোটে, আফগানিস্তান, সৌদি আরব, ইরানের অবস্থা থেকে সে কথা স্পষ্ট। আর নুজুদ তো ইয়েমেনের মেয়ে। হ্যাঁ, মধ্য প্রাচ্যের সবথেকে গরিব দেশ ইয়েমেন, যেখানে গৃহযুদ্ধ, তালিবানি হামলা, জঙ্গিহানাই রোজনামচা। সে দেশে মহিলারা নাগরিকের মর্যাদাটুকুও পান না। তার উপরে ইয়েমেনের আইনমতে বাল্যবিবাহ বৈধ। জনপ্রিয় ইয়েমেনি প্রবাদ বলে, কুমারী স্ত্রী পেতে চাইলে আট বছরের মেয়েকে বিয়ে করো। স্বভাবতই, সে দেশে শিশুদের বলপূর্বক বিয়ে দেওয়াটা নিতান্তই জলভাত। আর তেমনটাই ঘটেছিল নুজুদের সঙ্গে।
সে দেশের আর পাঁচটা মেয়ের মতো জীবনটা শুরু হলেও, তার জীবনটাকে নিজের হাতে বদলাতে চেয়েছিল নুজুদ। বিয়ের প্রথম রাতেই সে স্বামীর কথা অমান্য করেছিল। যদিও এর ফল তাকে ভোগ করতে হল পরদিন থেকেই। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি, আর রাত্রিবেলা স্বামীর অত্যাচার এবং ধর্ষণ। নুজুদ বাবার বাড়িতে ফিরে আসতে চাইলে তার বাবা নিদান দেন, শ্বশুরঘর ছেড়ে চলে এলে নুজুদের ঠাঁই হবে না বাপের বাড়িতে। এই দম-বন্ধ করা জীবন থেকে অবশেষে মুক্তি এল ২রা এপ্রিল, ২০০৮ তারিখে। নুজুদের বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী-র পরামর্শে নুজুদ রুটি কিনতে বেরনোর অছিলায় পালিয়ে চলে এল কোর্টে, স্বামীর থেকে বিবাহবিচ্ছেদের দাবি নিয়ে। কিন্তু আইনিভাবে যেখানে বাল্যবিবাহ সিদ্ধ, সেখানে কী করার আছে? তবুও হাল ছাড়েনি নুজুদ। তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তারই মতো এক লড়াকু মেয়ে, ইয়েমেনের প্রথম মহিলা আইনজীবী শাদা নাসের। ইয়েমেনে বিয়ের সময় পারিবারিকভাবে চুক্তি করা হত যে, এই অল্পবয়সি মেয়েদের সঙ্গে তাদের স্বামীরা যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হতে পারবে না যতদিন না ওই বালিকারা শারীরিকভাবে যৌন সংসর্গের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। স্বামীর দ্বারা ধর্ষিত হওয়ায় বিবাহের পূর্বে হওয়া চুক্তি লঙ্ঘিত হয়েছে– এই যুক্তিতে মামলা করে শেষ পর্যন্ত জিতে গেলেন নুজুদ আর শাদা। বিচারক মহম্মদ আল-ঘাদা আইন বিপক্ষে জেনেও পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ঐ ছোট্ট মেয়েটির, নিদান দিয়েছিলেন নুজুদের স্বামী ও বাবা দুজনকেই গ্রেপ্তার করার। আর শেষমেশ বিচারকের প্রাথমিকভাবে দেওয়া পাঁচ বছরের ‘ইন্টেরিম ফ্রম ম্যারেজ’-র প্রস্তাবের বিরুদ্ধে গিয়ে ডিভোর্স আদায় করতে পেরেছিল নুজুদ। ১৫ই এপ্রিল, ২০০৮-এ কোর্ট বিবাহবিচ্ছেদের রায় ঘোষণা করে এবং নুজূদের স্বামীকে তার প্রাক্তন স্ত্রীকে বিবাহের চুক্তিভঙ্গের ক্ষতিপূরণ হিসেবে মাসিক ২৫০ মার্কিন ডলার দেওয়ার আদেশ দেয়। নুজুদ হয় বিশ্বের কনিষ্ঠতম ডিভোর্সি। এই লড়াইকে সম্মান জানিয়ে সে বছর মার্কিনি উইমেন্স ম্যাগাজিন ‘গ্ল্যামার’-এ ‘উইমেন অফ দ্য ইয়ার’ হিসেবে নির্বাচিত হয় বছর দশেকের ওই ছোট্ট মেয়েটি।
আরও শুনুন: ২০২২-এও বদলায়নি অবস্থা, প্রায় সব ক্ষেত্রেই হাত বাঁধা মেয়েদের, বলছে মানবাধিকার কমিশন
মামলা জেতার পর অন্য শহরে গিয়ে ফের পড়াশোনা শুরু করে নুজুদ। ২০০৯ সালেই নিজের জীবনের গল্প নিয়ে ফরাসি সাংবাদিক ডেলফিন মিনোউই-র সঙ্গে একটি বই লিখে ফেলে সে, যার নাম- “I am Nujood, Age 10 and Divorced”। আজ প্রায় দেড় দশক পেরিয়ে এসে যে বই পথ দেখাচ্ছে নুজুদের মতো আরও অনেক মেয়েকে।