মেয়েদের কেরিয়ারে উন্নতির পথে বিয়ে শাস্তিরই নামান্তর। উপমহাদেশের মেয়েদের সংসার আর পেশার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে এমনটাই মনে করছে খোদ বিশ্ব ব্যাঙ্ক। ঠিক কী বলছে ব্যাঙ্কের সমীক্ষা? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
উপমহাদেশের মেয়েদের কেরিয়ারে সাফল্য আসার পথে ঝুলছে শাস্তির খাঁড়া। সে শাস্তির নাম বিয়ে, বলছে খোদ বিশ্ব ব্যাঙ্ক। কেন বলছে, সে কথা বুঝে নিতেই বরং একটা গল্প বলা যাক।
সেটা ১৯৮৮ সাল। সেলিমা জন নামে এক মহিলা ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নার্স হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮৮ সালে তাঁর বিয়ে হয়। তার পরই তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন কর্তৃপক্ষ। তাঁকে যখন বরখাস্ত করা হয়, তখন তিনি লেফটেন্যান্ট পদে। কেন তাঁর চাকরি গেল, তার কারণ হিসাবে দেখানো হয়েছিল সেলিমার বিয়েকেই। অর্থাৎ কর্তৃপক্ষ ধরেই নিয়েছিলেন যে, বিয়ে হয়ে যাওয়া মানেই সংসারের দায়দায়িত্ব মেটাতে গিয়ে বাইরের কাজে আর প্রয়োজনীয় শ্রম বা মনোযোগ দিয়ে উঠতে পারবেন না মহিলা। এ ঘটনা যে আদৌ বিচ্ছিন্ন নয়, তার প্রমাণ, ১৯৭৭ সালে সেনাবাহিনীতে চালু হওয়া একটি নিয়ম। যেখানে বলা হয়েছিল, বিয়ের কারণে সামরিক নার্সিং চাকরিতে কর্মরত কোনও সদস্যকে বরখাস্ত করা যাবে।
যদিও ১৯৯৫ সালে সেই নিয়ম প্রত্যাহার করা হয়, ওই বরখাস্ত মহিলার দায়ের করা মামলাতেও সুপ্রিম কোর্টে ধাক্কা খায় কেন্দ্র, কিন্তু এইসব ঘটনার দরুন মেয়েদের কাজের দুনিয়ার একটা ছবি উঠে আসে। যেখানে মেয়েদের ক্ষেত্রে বিয়ে আর কাজের সম্পর্ক অনেকটা ব্যস্তানুপাতিক। শুধু সেনাবাহিনী কেন, রুপোলি দুনিয়াতেও এমন ধারণা প্রচলিত যে বিয়ে করলেই নাকি নায়িকাদের কেরিয়ার শেষ। কর্পোরেট জগতে, বেসরকারি কাজের দুনিয়ায়, এমনকি অসংগঠিত ক্ষেত্রে মেয়েদের নিয়োগ করার বিষয়েও তাদের বিয়ে অনেকসময়েই প্রভাব ফেলে। বিবাহিত মহিলা মানেই কাজের দুনিয়ায় তাকে সম্পূর্ণ পাওয়া যাবে না, এমন ধারণা থেকেই মেয়েদের কাজের সুযোগ কমে।
আসলে এই ধারণার নেপথ্যে জাঁকিয়ে বসে আছে সমাজের প্রচলিত ছক। যেখানে মেয়ে মানেই যেন দশভুজা। ঘরে বাইরে সব কাজ সামলানো তারই দায়। মেয়ের সব কাজ পারা-কে এমনই মহিমান্বিত করে দেখানো হয়, যে, না-পারার কথা সে বলেই উঠতে পারে না কখনও। বা, বলতে শেখেই না। আর এরই প্রভাব পড়ে তার ব্যক্তিগত ভালো থাকায়। তার ব্যক্তিগত সাফল্যের খতিয়ানে। কেন-না, সকলের জন্য নিজেকে খণ্ডে খণ্ডে বিলিয়ে দিতে দিতে ব্যক্তিগত পরিসরেই তার নিজেকে দেওয়ার ভাগ কমে যায়। ফলে একান্তই যা নিজের কাজ, নিজের জন্য কাজ, আপস করতে হয় সেখানে। বিশেষ করে যে মেয়েরা সাত পাকে ঘোরার সূত্র ধরে অন্য আরেকটি সংসারে গিয়ে পড়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এ কথা আরও বেশি করে সত্যি হয়ে ওঠে অনেক ক্ষেত্রেই। নিজের পরিবারে যদি বা কোথাও খানিক হাঁফ ছাড়ার অবকাশ থাকে, অন্য কোথাও তেমনটা মিলবে না, এ কথা এই উপমহাদেশের মেয়েরা কমবেশি ধরেই নেন। তাঁরা জানেন, অন্য সংসারে বউয়ের কাজের উপর নজরদারি, তার কাজের খতিয়ানের হিসেবনিকেশে থাকবে কড়া চোখ। কর্মক্ষেত্রে প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারলে অ্যাপ্রাইজাল মিলবে না, প্রোমোশন হবে না ঠিকই। কিন্তু ঘরের কাজে বিন্দুমাত্র ঘাটতি হলে যে দমচাপা অবস্থা তৈরি হবে, তার থেকে রেহাই পেতে অনেক মেয়েই কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়াকেই মেনে নেন।
এ কথা এতদিন ছিল ওপেন সিক্রেট। সমাজ সংসারে আড়ালে আবডালে এ কথা বলা হচ্ছিল আস্তে আস্তে। কোনও কোনও মেয়ে দশভুজা হওয়ার ছকটিকে চিনতে পেরে তার সমস্যা আর সংকট নিয়ে কথা বলছিলেন। কিন্তু এবার বিশ্ব ব্যাঙ্কের সমীক্ষাতেও প্রকাশ্যে এল সে কথা। সে সমীক্ষা বলছে, ভারতে ‘female employment rate’ অর্থাৎ মেয়েদের নিয়োগের হার বিয়ের পর ১২ শতাংশ কমে যায়। একে ‘ম্যারেজ পেনাল্টি’ বলে চিহ্নিত করছে বিশ্ব ব্যাঙ্ক। যে নারীদের সন্তান রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে ‘চাইল্ড পেনাল্টি’-র কথাও বলা হচ্ছে, অর্থাৎ নিয়োগের হার সেখানে আরও কম। গোটা দক্ষিণ এশিয়াতেই ফিমেল লেবার ফোর্স-এর কাজে অংশগ্রহণের হার ২০২৩ সালে ছিল মাত্র ৩২ শতাংশ। এই স্বল্প হার যে জিডিপিতেও বড় প্রভাব ফেলছে, একবাক্যে সে কথা বলছে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক। কিন্তু সে কথা শুনে ঘরে এবং বাইরে দু’ক্ষেত্রেই মেয়েদের প্রতি মনোভাব বদলাবে কি? এ প্রশ্ন জোরালো হওয়া জরুরি। কেবল মেয়েদের জন্যই নয়, দেশের লক্ষ্মীলাভের জন্যই।