একদিকে তথাকথিত গৌরবোজ্জ্বল সূচনা, অন্যদিকে দেশের গৌরব মিশল লাঞ্ছনার মাটিতে। যেদিন আত্মনির্ভর ভারতের সূর্যোদয়ের সাক্ষী থাকল নতুন ভারতবর্ষ, সেদিনই যেন চিহ্নিত হয়ে গেল আত্মনির্ভর মহিলাদের সম্মানের সূর্যাস্ত। ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে মাথা ঠেকানো ছাড়া সত্যিই আর কি কিছু করার আছে এ-দেশের হতভাগ্য মেয়েদের! লিখলেন, সুলয়া সিংহ।
একদিকে মহাসমারোহ, অন্যদিকে লাঞ্ছনা। একদিকে তথাকথিত গৌরবোজ্জ্বল সূচনা, অন্যদিকে দেশের গৌরব মিশল লাঞ্ছনার মাটিতে। যেদিন আত্মনির্ভর ভারতের সূর্যোদয়ের সাক্ষী থাকল নতুন ভারতবর্ষ, সেদিনই যেন চিহ্নিত হয়ে গেল আত্মনির্ভর মহিলাদের সম্মানের সূর্যাস্ত। অথচ দাবি আর ছিল কতটুকু! সামান্যই তো। যৌন হেনস্তার প্রতিকার। সুবিচার। দিনের পর দিন তার জন্য চলেছে ধরনা আন্দোলন। যেদিন নতুন ভারতে সোনার ‘ন্যায়দণ্ড’ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, সেদিনও ন্যায়ের জন্য তাই তাঁদের লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। না, তেমন কোনও সোনার দিনের স্বপ্নে নয়। শুধুমাত্র ওই হৃত আত্মসম্মান ফিরে পাওয়ার আশায়। কিন্তু হায়! কে জানত তাঁদের জন্য বরাদ্দ আছে ‘রাজা’র দণ্ড! অমৃতকালের সূচনালগ্নের মোক্ষম দিনটিতেই তা-ই গোটা দেশ হতবাক হয়ে দেখল, মাটিতে পড়ে আছেন তাঁরা, যাঁরা দেশের পতাকাকে তুলে ধরেছিলেন বিশ্বের মঞ্চে, দেশকে পৌঁছে দিয়েছিলেন বিশ্বের শীর্ষে। গোটা দেশ যেন মুহূর্তে বুঝল, অমৃতমন্থন কালে উঠে আসে হলাহলও। এদিন সেই বিষ ধারণ করেই যেন নীলকণ্ঠ হয়ে রইলেন সাক্ষী-ভিনেশরা।
আরও শুনুন: সংসদ ভবন উদ্বোধনে যজ্ঞ থেকে সর্বধর্ম প্রার্থনা, প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে খুশি ধর্মগুরুরা
সাক্ষী-ভিনেশদের উপর যে নিগ্রহ নেমে এল, তা একদিক থেকে অশনিসংকেত। একে যদি কেবলমাত্র অভিযান আটকানোর ঘটনা হিসাবে দেখি, তাহলে বোধহয়য় একটু ভুল হয়ে যায়। মনে রাখতে হবে, এই অভিযানটি কীসের জন্য! যৌন নিগ্রহের প্রতিকার চেয়ে যদি এই গণতন্ত্রে নিগ্রহই উপহার হয়ে আসে, আর তার শিকার হয়ে ধুলয় লুটোন দেশের তারকা মহিলা অ্যাথলিটরা, তবে তার জোরালো প্রভাব পড়ে দেশের নারীদের উপর। পুরুষদেরও মাথা হেঁট হয় না কি! ভাবুন তো, এ দেশের মেয়েদের ঠিক কী কী নিষেধের খোপে আটকে আটকে থেকে এগিয়ে যেতে হয়। বেশি কথা বোলো না, লোকে বাচাল বলবে। বেশি রাত অবধি বাড়ির বাইরে থেকো না, চুল খুলে রেখো না, খোলামেলা ধরনের পোশাক পোরো না। একা ঘুরতে যেও না, এমনকী স্বার্থপরের মতো শুধু নিজেকে নিয়ে স্বপ্নও দেখো না। এই ‘না’-এর বৃত্তের মধ্যেই বড় হতে শেখে ভারতের একটা বিরাট অংশের মেয়েরা। তারা ধরেই নেয়, মেয়ে হয়ে জন্মালে এটাই প্রাপ্য। কিন্তু যৌন হেনস্তার শিকার হলে প্রতিবাদও কোরো না! নিজের জন্য সুবিচারের দাবিও কোরো না! গোটা বিশ্বের কাছে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গেলেও মুখ বুজে সবটা মেনে নাও! এটাও কি প্রাপ্য? হাজারো ‘না’কে উপেক্ষা করে যাঁরা দুনিয়ার দরবারে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন, সেই সাক্ষী মালিক, ভিনেশ ফোগাটরা শুধু নন, এর উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না কেউই।
রাজনীতির খেলা আর খেলার রাজনীতি। এই দুয়ের মাঝে আজ পর্যুদস্ত মহিলা কুস্তিগিররা। যৌন হেনস্তার অভিযোগ তুলেছেন তাঁরা কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে। জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যপরীক্ষার নামে অশালীন ভাবে তাঁদের শরীর স্পর্শ করা হয়েছে। স্তনে, পেটে আপত্তিকর ভাবে হাত দেওয়া হয়েছে। তাই এহেন সভাপতির অপসারণ চাই, চাই গ্রেপ্তারি। কিন্তু কোথায় কী! পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রক্ষাকর্তাদের আত্মসম্মানে জোর ধাক্কা দিয়েছে এই অভিযোগ। তাই পালটা শুনতে হচ্ছে, মহিলা কুস্তিগিররাই নাকি মিথ্যে অভিযোগ তুলছেন। এমনটা হতেই পারে না। উনি নাকি বাবার মতো! সত্যিই, দেশের বহু প্রান্তে রোজ এমন ঘটনা ঘটে। কিছু সামনে আসে, বেশিটা থেকে যায় অন্ধকারে। এমনকী বাবার কুকর্মের কথাও বিশ্বাস করেন না মা! সেটাও তো প্রাপ্য নয়।
২০১৬ রিও অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ পদক নিতে তেরঙ্গা জড়িয়ে পোডিয়ামে উঠেছিলেন সাক্ষ্মী মালিক। ২০১৮ এশিয়ান গেমসে ভিনেশ ফোগাটের সোনাজয়ের পর যখন জাতীয় সংগীতের সুর বেজেছিল, সেদিন চোখ ভিজেছিল দেশবাসীর। গর্বে মাথা উঁচু হয়েছিল। বলতে পারেন, কেন নিজেদের পদক জয়ের লক্ষ্য, অনুশীলন, ঘর-পরিবার ছেড়ে তাঁরা রোদ-ঝড়-জলের মধ্যে বসে রয়েছেন তাঁরা? কাউকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসাতে? রাজনীতি খেলা উপভোগ করতে? ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনও পুরুষ মানুষের স্পর্শ যে মেনে নেওয়া যায় না, এই সহজ বিষয়টা সরকারের বুঝতে এত অসুবিধা কোথায়? রাজধানীর বুকে তাঁদের টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে তোলা হল পুলিশ ভ্যানে। মারধর করা হল! ক্ষমতা আর দম্ভের নোংরা খেলায় শুধু ভিনেশরা নন, অপমানিত দেশের সমস্ত নারীরাই। ভরা বাজারে যেন পুনরায় বস্ত্রহরণ হল নারী সমাজের। আর দর্শকের ভূমিকায় তারা, যাদের ভোট দিয়ে বসানো হয়েছে গণতন্ত্রের মাথায়। ‘বেটি বাঁচা’নোর বচন শোনান যাঁরা, তাঁরা দেখলেন আর নিরুত্তর থাকলেন। এ লজ্জা কি শুধু দেশের নারীর, পুরুষদেরও নয়। এ লজ্জা কি আখেরে দেশের আর দশেরই নয়!
আরও শুনুন: অলৌকিক নয় লৌকিক, যেন শ্রম আর ঘামে লেখা রূপকথা ‘রিঙ্কু সিং নট আউট’
আজ বিশ্ব দেখছে ‘ভারতমাতা’র এই লাঞ্ছনা। এ-লজ্জা যে গোটা দেশেরই। পদক জয়ের পর যাঁদের সঙ্গে সেলফি তুলতে নেতা-মন্ত্রীরাও লাইন দিয়েছিলেন, ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন, তাঁদের আজ মুখে কুলুপ। আর ভূলুণ্ঠিত ওই পদকজয়ীরা। কিন্তু আমরা এ-ও জানি, শত লাঞ্ছনার সত্ত্বেও ওঁরা লড়বেন। কারণ ভারতমাতা হার মানতে শেখেনি। আরও অনেক আগুন হয়তো তাঁদের পেরোতে হবে। আগামীর সেই আগুনপথের দিকে তাকিয়েই মনে হয়, সোনার রাজদণ্ড যখন নতুন ভারতের গৌরব মুহূর্তের সূচনা করছে, তখন এ-লজ্জা কোথায় রাখি!
ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে মাথা ঠেকানো ছাড়া সত্যিই আর কি কিছু করার আছে এ-দেশের হতভাগ্য মেয়েদের!