ভদ্রলোকের খেলা বলেই নামডাক ছিল ক্রিকেটের। কিন্তু মাঝমাঠের খেলা যে কখন সত্যিই লড়াইয়ের তকমা পেয়ে গেল, আর সেই লড়াই মাঠের বাইরেও এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ল যে আক্রমণের নিশানায় এসে পড়লেন খেলোয়াড়দের প্রেমিকা-স্ত্রী-সন্তানেরাও, তা কি খেয়াল করলাম আমরা? তাহলে কি শেষ পর্যন্ত আর জেন্টলম্যান’স গেম নয়, একরকম হিংস্র লড়াইয়েই ভোলবদল ঘটে গেল ক্রিকেটের?
জীবনানন্দ লিখেছিলেন, যুদ্ধ সবকিছু নিয়ে যায়। নারীকেও। সত্যিই তো, কেবল প্রতিপক্ষকে হারিয়ে কবেই বা কোন বিজয়ী শান্ত হয়েছে? হেরে যাওয়া মানুষের নিজের বলতে যা কিছু, তার সম্পত্তি সম্পদ, এমনকি স্ত্রী-সন্তান-পরিবারের উপরেও অধিকার কায়েম করতে চেয়েছে শক্তিশালী পক্ষ। আবার পাশার দান যখন উলটেছে, তখন অন্য পক্ষেও দেখা গিয়েছে একই প্রবণতা। ক্ষমতা, সে ছোট বড় যাই হোক, সে আসলে সবকিছুকে গুঁড়িয়ে দিতেই চায়। আর দুই ক্ষমতার লড়াইয়ের মাঝে কোল্যাটারাল ড্যামেজ হয়ে ঢুকে পড়ে নারী, শিশু, কিংবা উলুখাগড়ার মতো নিছক ক্ষমতাহীন কিছু মানুষ।
আরও শুনুন: কোহলি-শামি একসঙ্গেই লেখেন দেশের রূপকথা, বিশ্বকাপ ফুরোলে দেশবাসী মনে রাখবে তো?
প্রশ্ন হল, এই প্রবণতা যুদ্ধের একচেটিয়া ছিল। কিন্তু খেলা, বিশেষ করে দলগত খেলা, তার তো এমন কোনও দায় ছিল না। বরং এ কথাই কি সত্যি নয় যে, আসলে যে কোনও খেলারই একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষকে জুড়ে থাকতে শেখানোর কথা ছিল? এই নিষ্ঠুরতার দুনিয়ায়, একজন মানুষের পাশ থেকে আরেকজনের মসৃণভাবে সরে যাওয়ার দুনিয়ায়, মানুষকে বেঁধে থাকতে শেখানোরই কি কথা ছিল না খেলার? সেখানে কখন যেন খেলার সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়াল লড়াই। শত্রুকে দুরমুশ করে দেওয়া। আর সেই শত্রুতার বয়ানে চুপিচুপি মুছে গেল খেলোয়াড়ি বেঁধে থাকার গল্পগুলো। বদলে জেগে উঠল তীব্র, হিংস্র হুংকার। সে হুংকারের নিশানা কেবল প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়েরাই নন, সেই খেলোয়াড়দের সঙ্গিনী বা পরিবার। এমনকি খেলার সঙ্গে জুড়ে থাকা যে কোনও নারীই অনায়াসে সেই আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালেন, ঠিক যেভাবে প্রতিপক্ষের দিকে ছুড়ে দেওয়া যে কোনও গালিতে জুড়ে যান তার মা-বোন-স্ত্রীরা।
সাম্প্রতিক বিশ্বকাপের ময়দানেও কি তেমন ঘটনা দেখলাম না আমরা? এমনিতেই কোহলির রান না পাওয়ার জন্য, ভারতের ট্রফি না জেতার জন্য আগে বারবার আঙুল উঠেছে অনুষ্কার দিকে। শুনতে হয়েছে ‘অপয়া’ বদনাম। শামিকে ধর্ম নিয়ে আক্রমণের জোয়ারে বিরাট যখন বাধা দিয়েছেন, তখন ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছে তাঁর শিশুকন্যাকেও। এবার অবশ্য লাগাতার রানের বন্যায় সমালোচকদের মুখ বন্ধ করেছিলেন বিরাট। কিন্তু তাঁর জন্য গ্যালারিতে অনুষ্কা আছেন আর শামির স্ত্রী হাসিন কেন স্টেডিয়ামের বদলে কোর্টে ছুটছেন, তা নিয়ে বাঁকা কথা বলতে ছাড়েননি অনেকেই। শামির বিরুদ্ধে ওঠা গৃহহিংসার অভিযোগ যে এখনও বিচারাধীন, সে কথা কেউ মনে রাখেননি। এমনিতে যে শামিকে বারবার ধর্ম নিয়ে খোঁচা শুনতে হয়, তিনি বিশ্বমঞ্চে দেশকে তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গেই সেই তোপের মুখ ঘুরে গিয়েছে হাসিনের দিকে। আবার মেগা ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে অস্ট্রেলিয়া কাপ নিয়ে যাওয়ায় শুধু অজি শিবিরকে আক্রমণ করেই সন্তুষ্ট হননি এই ভক্তমহল। ট্রেভিস হেডের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেল উপচে উঠেছে তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের দিকে ধেয়ে আসা ধর্ষণের হুমকিতে। শুধু কি ক্রিকেটারদের স্ত্রীরাই আক্রমণের লক্ষ্য? ভারত-নিউজিল্যান্ডের সেমিফাইনালের দিন, মাঠে সঞ্চালনা করার সময় কেন ছোট ঝুলের পোশাক পরেছেন, তা নিয়ে চূড়ান্ত ট্রোলের শিকার হয়েছেন মায়ান্তি ল্যাঙ্গার। সেমিফাইনালে গাভাসকরের পাশে দাঁড়িয়ে সঞ্চালনার সময় মায়ান্তির পরনে ছিল ফর্মাল স্কার্ট আর ব্লেজার। অনেকের চোখে এই পোশাক যথেষ্ট মার্জিত নয়, সুতরাং সোশ্যাল মিডিয়া ছেয়ে গিয়েছে মায়ান্তির বিকৃত ছবিতে।
আরও শুনুন: টক্করের মাঝেও প্রতিপক্ষের দিকে সাহায্যের হাত ঈশানের… যুদ্ধ ছাপিয়ে ভালোবাসার নাম ক্রিকেট
সত্যি বলতে, এমন ঘটনা আদৌ নতুন নয়, অভিনবও নয়। ক্রিকেট মাঠের স্লেজিং ও মাঠের বাইরের এই পারস্পরিক আক্রমণ, দীর্ঘদিন ধরে এই প্রবণতাকে একরকম মান্যতা পেয়েই আসছে। ঠিক যেমন ফুটবলেও মাঠের মাঝে জিদানের উদ্বাস্তু পরিবার তুলে কটাক্ষ করা, কিংবা কলকাতা ডার্বির সময় দেশভাগ আর কাঁটাতারের দাগ নিয়ে ব্যঙ্গের চলকে আমরা স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়েছি। কিন্তু আক্রমণ, বিশেষ করে নিরপেক্ষ কারও উপর আক্রমণকে কি সত্যিই স্বাভাবিক বলা যায়? যে ক্রিকেটপ্রেমীরা ‘টাইমড আউট’-এর নিয়মকে জেন্টলম্যান’স গেমের পরিসরে আঁটাতে চান না, তাঁরা কি ক্রিকেটারদের প্রতি ব্যক্তিআক্রমণ, উপরন্তু তাঁদের প্রিয় নারী বা পরিজনদের নিয়ে আক্রমণের সঙ্গে জেন্টলম্যান’স গেমের কোনও সংযোগ খুঁজে পান আদৌ? তবুও যে এই প্রবণতা দিনের পর দিন অনায়াসে জারি থেকে যায়, তাতে সংশয় জাগে, তাহলে কি আমাদের চুপ থাকার সুযোগে সত্যিই জেন্টলম্যান’স গেম থেকে লড়াইয়েই পালটে গেল ক্রিকেট?