অগণিত ফুটবলপ্রেমীর আবেগ ভালোবাসা যাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়, সেই মেসি চললেন ইউরোপ ছেড়ে আমেরিকার উদ্দেশে। তাঁকে শেষবারের মত বার্সার জার্সিতে দেখতে চেয়েছিলেন তাঁর অগণিত ভক্তরা। মেসির প্রাপ্য সম্মান, প্রাপ্যা বিদায়- যা শেষবার দেওয়ার সুযোগ পায়নি তাঁর ভালবাসার ক্লাব বার্সেলোনার ভক্তরা, এবার সেটা উজাড় করে দেওয়ার জন্য তৈরি ছিলেন সবাই। তিনিও আসার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। তা সত্ত্বেও শেষমেশ তিনি বেছে নিলেন মেজর লিগ সকারের ক্লাব ইন্টার মায়ামিকে। আর তাতেই যেন খাপ্পা মেসিভক্তদের একাংশ। কিন্তু মেসি কি কেবলই আনন্দ দেওয়ার যন্ত্র! নিজের জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার কি একান্ত তাঁরই নয়? লিখলেন, শঙ্খ বিশ্বাস।
মেসি। লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। অসংখ্য যুদ্ধের নায়ক তিনি। বার্সেলোনা ও আর্জেন্টিনা ভক্তদের কাছে ফুটবলের অবিসংবাদিত নায়ক। একটা গোটা প্রজন্ম যাঁর খেলা দেখে মুগ্ধ হয়েছে, যাঁর বল পায়ে ফুল ফোটানো দেখে বড় হয়েছে, যাঁর বাঁ পায়ের জাদুতে মোহিত হয়ে থাকে গোটা ফুটবল বিশ্ব। সেই মেসি তথাকথিত সেরা ফুটবল এর আঁতুড়ঘর ইউরোপকে বিদায় জানিয়ে চললেন আমেরিকার উদ্দেশে।
আর্জেন্টিনার রোসারিওতে ২৪ জুন ১৯৮৭-তে জন্মগ্রহণ করেন। ছোট থেকেই ফুটবলের প্রতি আলাদা একটা টান অনুভব করতেন। ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন শুরু সেই তখন থেকেই। ৬ বছর বয়সে রোসারিওরই একটি ক্লাবে তিনি যোগ দেন। ৬ বছর খেলেন তাঁর সেই প্রিয় ক্লাবে। আর এই সময়ে তিনি প্রায় ৫০০-র উপর গোল করেন। ভাবতে পারেন? ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন শুরু সেই তখন থেকেই। যদিও সেই স্বপ্নে প্রথম আঘাত এল যখন তখন তাঁর বয়স ১০ বছর। জানা যায় গ্রোথ হরমোনের অভাবে ভুগছেন তিনি। চিকিৎসার সামর্থ্য তখন ছিল না তাঁর বাবার। আর এরকম কঠিন সময় এগিয়ে আসে স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনা। ট্রায়ালে তাঁর খেলা দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে কাগজ-কলম না থাকায় তড়িঘড়ি একটি ন্যাপকিনকেই কন্ট্রাক্টের কাগজ বানিয়ে সই করায় এবং তাঁর চিকিৎসার সমস্ত দায়ভার গ্রহণ করে।
আরও শুনুন: টেস্ট চ্যাম্পিয়নের শিরোপা উঠবে কার মাথায়? WTC-র শুরুতেই ভবিষ্যৎ বলল ‘জ্যোতিষী’ AI
ইউরোপে তাঁর সেই শুরু। আর তারপর তো এলেন , দেখলেন, জয় করলেন। তাঁর অগণিত ভক্তদের এত এত আনন্দের মুহূর্ত দিয়েছেন, যা আবার ভাবতে বসে হয়তো কয়েক আলোকবর্ষ পেরিয়ে যাওয়া যায়। জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই দেখেছেন। একটা সময় জাতীয় দল আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ বা কোপা আমেরিকার অনেক কাছে এসেও বারবার খালি হাতে ফিরতে হয়েছিল তাঁকে। সমালোচনায় ঝাঁজরা হতে হয়েছে অসংখ্য বার। তাঁর সমালোচকরা তাকে বাক্তিত্বহীন বলতেও ছাড়েননি। আসলে সমাজের চোখে শান্তিপ্রিয় নির্বিবাদীদের হয়তো তা-ই ভাবা হয়। কিন্তু তিনি গায়ে মাখেননি। জানতেন, তাঁকে জবাব দিতে হবে তাঁর কাজে। আর ফুটবল জীবনের সায়াহ্নে এসে দিলেনও সেই জবাব। দীর্ঘ ২৮ বছর পর নিজের দেশকে বিশ্বে সেরা করলেন, আবারও জাত চেনালেন। দেখালেন আসল ব্যাক্তিত্ব কাকে বলে! ফুটবলে যেটা সম্ভব এরকম কোনও ট্রফিই তাঁর আর জিততে বাকি নেই। যে সব সমালোচকরা বলতেন সর্বকালের সেরা হতে গেলে মেসিকে বিশ্বকাপ জিততেই হবে নাহলে কোনও দিনই তাঁকে ‘সর্বকালের সেরা’ ভাবা হবে না। শেষমেশ তাঁরাও একপ্রকার মেনে নিতে বাধ্য হলেন যে, মেসির সমতুল্য অন্তত এই মুহূর্তে আর কেউ নেই।
আর কী-ই বা জেতার আছে তাঁর? কী-ই বা হারানোর আছে? সর্বকালের সবথেকে বড় কন্ট্রাক্ট ছিল তাঁর কাছে। সৌদির ক্লাব আল হিলাল তাঁকে দলে পাওয়ার জন্য ১.২ বিলিয়ন পর্যন্ত দিতে রাজি ছিল ২ বছরে। অন্য ইউরোপের ক্লাব থেকেও অফার ছিল। কিন্তু তিনি বেছে নিলেন ইন্টার মায়ামিকে। তারপর থেকেই দেখা যাচ্ছে, অনেকে অনেক কথা বলছেন। অনেক বিমর্ষ ভক্তই অভিমানী, কেউ বলছেন আর খেলা দেখবেন না তো কেউ আফসোস করছে আর কটা দিন কেন অপেক্ষা করলেন না মেসি! এর থেকে নাহয় ১.২ বিলিয়নে আল হিলালেই যেতেন যেখানে মিলিয়ন মিলিয়ন অর্থের বিনিময়ে রোনালদো, বেনজিমা, কান্টের মতো প্লেয়াররা যাচ্ছেন। কিন্তু তিনি গেলেন না কেন? বা কেন আর কটা দিন অপেক্ষা করে বার্সায় ফিরলেন না? কেন?
আরও শুনুন: মোদির জন্য নয়, দেশের জন্য পদক জিতেছেন, কুস্তিগিরদের হয়ে সুর চড়ালেন কীর্তি আজাদ
কেন জানেন? আসলে কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের টাকা দিয়ে কেনা যায় না, যাঁদের জীবনে টাকার থেকেও পরিবার-শান্তি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মেসি তাঁদেরই একজন। খেললে আর কতদিনই বা খেলতেন তিনি? আরো এক বছর? দু-বছর? বা খুব বেশি হলে ৩ বছর? জীবনের এতগুলো বছর যিনি আমাদের আনন্দ দিয়ে গেলেন , ফুটবলের জাদুতে মুগ্ধ করে গেলেন, তাঁর কি নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনও অধিকার নেই? প্রফেশনাল ফুটবল জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি যদি একটু প্রচার থেকে দূরে, শান্তিতে থাকতে চান, মেসির ভক্তদের কি তাতে খুব আপত্তি করা উচিত?
হ্যাঁ, তিনি চেয়েছিলেন, বার্সায় ফিরতে, চেয়েছিলেন একটা পাকাপোক্ত কন্ট্রাক্ট যেটা বার্সা তাঁকে দিতে পারেনি। বার্সার সময় দরকার ছিল। কিন্তু অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্য মেসি এবার সেই ভরসা পাননি। তিনি তাঁর ভবিষ্যৎ অন্য কারোর হাতে বন্ধক রাখতে চাননি। তাঁকে বার্সায় ফেরাতে গেলে বেশ কিছু প্লেয়ারকে বিক্রি করতে হত ক্লাবকে, এবং বাকিদের পারিশ্রমিকও কমাতে হতো। তিনি চাননি তাঁর জন্য কাউকে ক্লাব ছেড়ে যেতে হোক বা কারোর বেতন কমুক। ফুটবল জীবনের অন্তিম পর্যায়ে এসে সম্পূর্ণ একটা নতুন পরিবেশে তিনি নিজেকে এবং তাঁর পরিবারকে ফেলতে চাননি বিরাট অংকের প্রলোভন থাকা সত্ত্বেও। তিনি কি ভুল করেছেন? দুনিয়া তাঁকে ফুটবলের ভগবান বানালেও আসলে তো তিনি রক্তমাংসের মানুষই। তাঁর ভালো থাকার , নিজের পরিবারকে ভাল রাখার দায়িত্ব তো তাঁরই। আবার এরকমও নয় যে তিনিই প্রথম যিনি এই লিগে যোগ দিয়েছেন। এর আগেও তো ডেভিড বেকহাম, ওয়েন রুনি ,হেনরি, দ্রগবা, ল্যাম্পার্ড, জালাটান ,কাকা, পিরলো এঁদের মতো লেজেন্ডরাও এমএলএস-এ যোগ দিয়েছিলেন। তখন তো এরকম শোরগোল পড়েনি।
এই প্রসঙ্গে ইরফান খানের একটা সংলাপ খুব মনে পড়ছে। যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ‘ভালোবাসি বলেই তো যেতে দিয়েছি, ভালোবাসা না হয়ে জেদ হলে আটকে রাখতাম ।’ যাঁরা সত্যি মেসিকে ভালোবাসেন , তাঁদের উচিত মেসির এই সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানো, যেভাবে সব সময় এর জন্য মেসির ভালোসময় খারাপ সময় পাশে থেকেছেন। এই সিদ্ধান্তের পাশে দাঁড়ানো। যাঁরা ৯০-এর দশকে জন্মেছেন তাঁদের শৈশব কৈশোরে যে অগণিত মুহূর্ত উপহার দিয়েছেন এই মানুষটা, অন্তত সেইগুলোকে মনে রেখেই তাকে তাঁর মতো থাকতে দেওয়া উচিত। আর তো কয়েকটা বছর। মেসির মতো মহাতারকা যে যন্ত্র নন, আর পাঁচজন মানুষের মতো জীবন নিয়ে তাঁরও নিজস্ব ভাবনা আছে- এই সত্যটুকু অন্তত স্বীকার করেই নেওয়া উচিত তাঁর ভক্তদের।