ভক্তের আস্ফালনে আদতে লাভ হয়, নাকি ক্ষতিরই পাল্লা ভারী? সাম্প্রতিক ভোটে রাজনৈতিক দল সে কথা বুঝেছে বইকি। খেলার মাঠেও ভক্তদের প্রভাব কি সেই একই ধরনের? রান নিয়ে বিরাট-সুনীল কড়চায় উসকে উঠল সেই প্রশ্ন।
বাবু যত বলে, পারিষদ দলে বলে তার শত গুণ! এ কথা যে বর্ণে বর্ণে সত্যি, ভক্তদের আস্ফালন শুনলেই তা বোঝা যায়। ভক্ত বলতে স্রেফ ঈশ্বরভক্তদের কথা বলছি না কিন্তু। কেবল দেবতা না, মানুষের ভক্তরাও বিশ্বাস আর আবেগের জায়গায় প্রায় একইরকম গোঁড়া। রাজনীতি থেকে খেলা থেকে সিনেমা, যে কোনও নেতা থেকে তারকার ভক্তদের দিকে তাকিয়ে দেখুন। সেইসব ব্যক্তিকে নিয়ে একটি কথা বলেছেন কি বলেননি, রে রে করে প্রতিবাদে নেমে পড়বেন ভক্তরা। গুরুর কোনও কাজ ঠিক না ভুল, যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে তা বিচার করতে এঁদের বড়ই অনীহা। আর যাঁরা তা করতে চান, তাঁদের এককথায় শত্রু বলে দাগিয়ে দিতে এঁরা দুবার ভাবেন না। অথচ প্রশ্ন করা মানেই তো কেউ শত্রু নন, শত্রু ছিলেনও না। কিন্তু এই আচরণের জেরেই যে তাঁদের মনে বিরূপ ধারণা তৈরি হয়ে গেল, সে কথা ভক্তরা বুঝলে তো! ভক্তদের এই আস্ফালন যে আসলে সেই ব্যক্তিদেরও চোখ ধাঁধিয়ে দিতে পারে, তাঁদেরও বিচার বিশ্লেষণ করে নিজেদের অবস্থান বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হতে পারে, সে কথা ওই নেতা বা তারকারাও কি বোঝেন?
আরও শুনুন:
প্রতিভাই কি সব! সাফল্যের তিন মন্ত্র শিখিয়ে দিলেন ফেডেরার
প্রশ্নটা উঠছে রান প্রসঙ্গে বিরাট কোহলি আর সুনীল গাভাসকরের কথার সূত্রে। সপাট ব্যাটে বিপক্ষকে দুরমুশ করে দেওয়াও যেমন বিরাটের স্বভাব, তেমনই হঠাৎ হঠাৎ রান থেকেই হারিয়ে যাওয়াও তাঁর ধরন। এ নিয়ে একসময় তির্যক মন্তব্য করেছিলেন সুনীল গাভাসকর। তারপর বিরাট-ভক্তদের হাতে রীতিমতো ট্রোলড হয়ে যান তিনি। দেশের প্রথম বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য, প্রাক্তন ভারত অধিনায়ককে বিরাটের মাহাত্ম্য বোঝাতে একেবারে উঠেপড়ে লেগেছিলেন তাঁরা। এমনকি একসময় মুখ খোলেন বিরাট নিজেও। তবে ভক্তদের থামানো দূরে থাক, তিনিও কার্যত বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, সুনীল যেহেতু কখনও টি-টোয়েন্টি খেলেননি, অতএব এই ফরম্যাটে রান পাওয়া নিয়ে তাঁর কথা বলা একরকমের অনধিকার চর্চা। সম্প্রতি তিন-তিনটি ম্যাচে এক ঘরে রান রেখেই বিরাটের আউট হয়ে যাওয়ার পর ফের সুনীলের কাছেই প্রশ্ন আসে, সমস্যাটা কী? তবে তার জবাবে এবার প্রায় কিছুই বলেননি সুনীল। বরং বিরাটের পাশে দাঁড়িয়েই সব বিতর্ক থামিয়ে দিয়েছেন তিনি।
কিন্তু কথা হচ্ছে, কেউ যদি ভিন্নমত পোষণ করেনও, তাহলেই কি তাঁকে আক্রমণ করতে হবে? সকলেই তো তেমনটা মনে করেন না। এমনও ক্রীড়াপ্রেমীরা আছেন, যাঁরা মনে করেন না যে এক দল বা এক ব্যক্তিকে সমর্থন করলে অন্য দল বা খেলোয়াড়কে আক্রমণ করতেই হবে। এমনও ক্রীড়াপ্রেমীরা আছেন, যাঁরা বিরাটের খেলা ভালোবেসেও তাঁর ফর্ম নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পারেন। সেই বিশ্লেষণের, যুক্তির, কথা চালাচালির পরিসর বজায় থাকলে আদতে কিন্তু লাভ বই ক্ষতি নেই। সেই পরিসর বজায় থাকলেই বর্ষীয়ান খেলোয়াড়দের থেকে অনুজ খেলোয়াড়রা পরামর্শ পেতে পারেন। কিন্তু ভক্তদের আস্ফালনে তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্কও যে ঘা খায়, তাতে লাভ কিছু হয় কি? উপরন্তু কিছু ভক্তদের এই প্রবণতা যে আরও একটা বড় অংশের সমর্থকদেরও আহত করে, সে কথাও তো ভাবার।
আরও শুনুন:
ঠিক চালে কিস্তিমাত, আছে রাজা-মন্ত্রীও! বুদ্ধির খেলায় নেতারাও যেন দাবাড়ু
সাম্প্রতিক কালের ভোট আবহ কিন্তু এই পাঠই দিয়েছে একরকম করে। এই সময়ে ‘ভক্ত’ বললে প্রথমেই যাদের কথা মনে পড়ে, সেই বিজেপি শিবিরের সমর্থকদের আস্ফালন দিনে দিনে আকাশ ছুঁয়েছিল। ঘৃণাভাষণ থেকে কুৎসিত ব্যক্তিআক্রমণ, সবকিছুই জ্বলজ্বল করছিল সেখানে। কিন্তু যে সাধারণ ভোটাররা অনেকখানি নিরপেক্ষ অবস্থানে ছিলেন, কোনও দলীয় বিশ্বাসে থিতু হওয়ার বদলে যাঁরা হাওয়া বুঝে বা দলের কাজ দেখে ভোট দেন, সেই আস্ফালন তাঁদের অনেককেই দিনে দিনে থমকে দিয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে ভোটবাক্সে। কেবল বিজেপি কেন, অন্য রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষেত্রেও কিন্তু এ কথা কিছু না কিছু মাত্রায় সত্যি। যেমন পার্টিলাইনকে মান্যতা না দিয়েই ভাতা নিয়ে আমজনতাকে যেভাবে কটাক্ষ করছেন বাম সমর্থকদের একাংশ, তাতে আদতে ক্ষতি হচ্ছে দলেরই। ভক্তদের আস্ফালনে ভোট যে কমে যায়, রাজনৈতিক দলগুলি সে কথা বুঝছে বইকি। কিন্তু খেলার মাঠেও ভক্তদের উগ্র আস্ফালন যে খেলোয়াড়কে আদৌ ব্রাউনি পয়েন্ট দেয় না, বিরাট বা অন্যেরা সে কথা বুঝবেন তো?