দীর্ঘ ২৩ বছরের ক্রিকেট কেরিয়ারে ইতি টানলেন মিতালি রাজ। দুই দশকের ক্রিকেট কেরিয়ারে ব্যক্তিগত অর্জন তো আছেই, তবে সে-সব পেরিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটকে তিনি দিয়ে গেলেন অনেক কিছু। স্কোর-বোর্ড সেই সবকিছুর হয়তো হিসাব রাখে না। যে সম্ভ্রম, মর্যাদায় তিনি ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটকে উন্নীত করলেন, তার তুলনা অন্য কোথাও, অন্য কারও ইতিহাসে খোঁজা বৃথা। সেই বর্ণময় জীবন ফিরে দেখলেন কৃশানু মজুমদার।
বিশ্বকাপের মঞ্চে লজ্জার বিদায়ের পর আর নীল জার্সিতে নামেননি। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন। তর্কাতীতভাবে।
না, ইনি মহেন্দ্র সিং ধোনি নন।
আরও একটু ক্লু দেওয়া যাক। ২৩ বছর জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করে ইনিই দেশের তিন ফরম্যাটে রানের ফুলঝুরি ছুটিয়েছেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রান সংগ্রাহকও তিনি।
না, ইনি শচীন রমেশ তেন্ডুলকরও নন।
আরও শুনুন: ‘অফসাইডের ঈশ্বরী’… অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ইতিহাস গড়া স্মৃতিকে নিয়েও হোক হইচই
শচীন-ধোনির দুই মহাকাব্য যেন এক মলাটে বাঁধা পড়েছে মহিলা ক্রিকেটে! যে মলাটের নাম মিতালি রাজ। বুধবারই যে উপন্যাসের শেষ পাতা লেখা হয়ে গেল। নীরবেই। বলা ভাল, স্বয়ং মিতালি একটি মাত্র টুইটেই তাঁর জীবনের এক সোনালি অধ্যায়ে দাঁড়ি টেনে দিলেন।
জানিয়ে দিলেন, অনেক হয়েছে, আর নয়। আলবিদা! হঠাৎ যেন বাইশ গজের মখমলে ফুটে উঠল অজস্র স্মৃতি আর অত্যাশ্চর্য সমস্ত কীর্তির খতিয়ান।
আরও শুনুন: সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে… বিরাটের আগেও অধিনায়কত্ব বিতর্কে বিদ্ধ হয়েছেন এই কিংবদন্তিরা
সাল ১৯৯৯! শচীন রমেশ তেন্ডুলকর ততদিনে প্রায় একদশক রাজত্ব করে ফেলেছেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও এসে পড়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটের আঙিনায়। অ্যান্টেনা টিভি, ডিডি নিউজ, আর ভারী ল্যান্ডফোনের যুগ তখন এই দেশে। মহিলাদের ক্রিকেট নিয়ে কেউ সেভাবে উৎসাহীও ছিলেন না। কে জানত, সেই জমানায় খেলনাবাটি, শাড়ি, সিরিয়ালের আকর্ষণ সরিয়েও হাতে ব্যাট তুলে নেওয়া যায়। দুনিয়ার সামনে পুরুষালি হুংকারে ঘোষণা করা যায় নিজের আগমন। অবিশ্বাস্য কীর্তি গড়ে বুঝিয়ে দেওয়া যায়, ‘হোয়াই শ্যুড বয়েজ হ্যাভ অল দ্য ফান!’
মিতালি রাজ এমনই। আলাদা। ভীষণভাবেই আলাদা। যে মোহনায় ধোনির শীতল ঔদ্ধত্য এবং শচীনের রাজকীয়তা মিলেমিশে একাকার। সমাজের থেকে ঢের এগিয়ে থাকা এক স্টপেজ।
ব্যাট হাতে গড়ছেন একের পর এক কীর্তির সৌধ। ১৯৯৯ সালের কথা বলা হচ্ছিল। সেই বছরই অভিষেক হয় মিতালির। আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে তাঁর ব্যাট। ঝকঝকে ১১৪ রানের ইনিংস খেলেন। ক্রিকেট বিশ্বকে জানিয়ে দেন, ”আমি এসে গিয়েছি।” বুধবারের পর সমস্ত কিছুই আপাতত অতীত। ভারতীয় ক্রিকেটের কুইনই যে আর রইলেন না! কিন্তু তাতে কী! মিতালি নিজে এগিয়েছেন, এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন দেশের মহিলাদের ক্রিকেটকে। সেইসঙ্গে মহিলাদের নিয়ে যে জোলাপ সেই ছেলেবেলা থেকে মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, সেইসব বস্তাপচা ধ্যানধারণাকে মাঠের বাইরে ফেলে দিয়েছেন। ধন্যবাদ মিতালি আপনাকে।
আরও শুনুন: অলিম্পিকে হিটলারের সঙ্গে হ্যান্ডশেক, এক ছবিতেই প্রাণ বেঁচেছিল এই অ্যাথলিটের
আমাদের এই সমাজে এখনও মনে করা হয়, মহিলারা ঘরকন্না করবে, সংসার সামলাবে। এর বাইরে তাঁদের কোনও অস্তিত্বই নেই। সেই ধ্যানধারণাকেও পেল্লাই ছক্কা হাঁকিয়ে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন মিতালি। একবার তাঁর দিকে উড়ে এসেছিল তেতো প্রশ্ন, আপনি বিয়ে করেননি কেন? জবাবে মিতালি বলেছিলেন, ”ছোটবেলায় বিয়ের কথা ভাবতাম। তবে বড় হয়ে বিয়ে করা অনেক মানুষকে দেখেছি। তাদের দেখে আমার আর বিয়ের ইচ্ছে হয়নি। আমি সিঙ্গেল আছি। এই বেশ ভাল আছি।”
এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। ২০১৭ বিশ্বকাপের ঠিক আগে সাংবাদিক বৈঠকে চেনা ছন্দেই উত্তর দিচ্ছিলেন। তখনই এক সাংবাদিক ছুঁড়ে দিলেন প্রশ্ন, ”আপনার প্রিয় পুরুষ ক্রিকেটার কে?” কেটে গেল তাল।
সেই সাংবাদিককে পাল্টা প্রশ্ন করেন মিতালি, ”আপনি এই একই প্রশ্ন কোনও পুরুষ ক্রিকেটারের কাছে জানতে চাইবেন?” একটু থেমে মিতালি আবার বলেন, ”আপনি কি পুরুষ ক্রিকেটারদের জিজ্ঞাসা করবেন তাঁদের প্রিয় মহিলা ক্রিকেটার কে? আমাকেই কেন এই প্রশ্ন সব সময় করা হবে? কেন তাদের নয়?”
মিতালির এই বক্তব্য ভাইরাল হয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাঁকে আর কিছু করতে হয়নি বরং তাঁর হয়েই লড়ে গিয়েছে গোটা বিশ্ব। মিতালি প্রশ্ন করেছিলেন সাংবাদিককে কিন্তু আসলে এই প্রশ্ন তো পুরুষশাসিত সমাজকেই। বাঁকা প্রশ্ন শুনে চুপ করে থাকার দিন শেষ মহিলাদের। চোখে চোখ রেখে উত্তর দেওয়ার সময় এসে গিয়েছে। পথপ্রদর্শক মিতালি।
মিতালি লড়াকু, হার না মানা এক মেয়ে। এই মেয়েই সবুজ গালচেতে এমন এক ছবি ফুটিয়ে তুললেন, যা স্মরণকালের মধ্যে দেখা যায়নি। ব্যাট হাতে নামার আগে স্থিতধী, শান্ত এক ক্রিকেটার বই পড়ছেন, এ দৃশ্য ক্রিকেট মাঠে সচরাচর দেখাই যায় না। পাঁচ বছর আগের এক বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৭১ রান করেছিলেন মিতালি। টানা ৭ ইনিংসে অর্ধশতরান। কিন্তু এই ধুন্ধুমার পারফরম্যান্স চলে যায় পিছনের সারিতে। তার থেকেও বেশি করে চর্চিত হয় ব্যাট করতে নামার আগে মিতালির বই পড়ার মুদ্রা। তাঁর সেই শান্ত ভঙ্গি দেখে একইসঙ্গে অবাক এবং উচ্ছ্বসিত ক্রিকেটমহল। একই অঙ্গে বিভিন্ন রূপ মিতালির।
ভরতনাট্যমে পারদর্শী ছিলেন। কিন্তু আলস্যি গ্রাস করেছিল মেয়েকে। বায়ুসেনায় কর্মরত বাবা অন্য কৌশল অবলম্বন করলেন। মেয়েকে ভরতি করে দেন ক্রিকেটে। ভাগ্যিস তিনি মিতালিকে ভরতি করে দিয়েছিলেন, নইলে ক্রিকেটে ‘রাজ’ করতেন কে? দশ হাজারের উপরেই বা রান করতেন কে? রবিঠাকুরকে আশ্রয় করেই বলা যায়, যেখান দিয়ে হেসে গেছে, হাসি তার রেখে গেছে রে…
অধিনায়ক ধোনি বিশ্বকাপ জিতেছেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পরে বিশ্বকাপ ছুঁয়েছিলেন শচীনও। দেশকে ফাইনালে তুলেও মিতালি স্বপ্নের ট্রফি এনে দিতে পারেননি। এই আক্ষেপ হয়তো থেকে যাবে তাঁর। কিন্তু দেশকে তিনি রেখে গিয়েছেন বিশ্বসেরাদের সঙ্গে একই ব্র্যাকেটে। তার থেকেও বড় ব্যাপার তিনিই প্রেরণা অনেকের। বদলে দিয়েছেন অনেকের দৃষ্টিভঙ্গি। এ তৃপ্তিই বা কম কী! বাণপ্রস্থে যাওয়ার এর থেকে সেরা সময় আর কীই বা হতে পারে।