অষ্টমবার ব্যালন ডি’অর জিতলেন লিওনেল মেসি। আর্লিং হালান্ডকে পিছনে ফেলে ফের দখল করলেন সোনালি বল। বিশ্বকাপ জয়ের পর প্রথমবার এই খেতাব উঠল আর্জেন্টিনার মহাতারকার হাতে। আর সেই পুরস্কারের মঞ্চেই ফুটে উঠল- ‘মেসি ইজ ইনফিনিটি’!
সালটা ২০০৪। একটা ১৭ বছরের ছিপছিপে রোগা ছেলের পা পড়ল বিশ্ব ফুটবল মঞ্চে! স্বভাবে নম্র, মিতভাষী, শান্ত। তবে মাঠে ততটাই ক্ষিপ্র! লম্বা চুল ছেলেটি যখন দৌড়ায়, পিছন থেকে বেশ লাগে। অদ্ভুত একটা ছন্দ আছে যেন। মানুষের মনে জায়গা করতে শুরু করে ছেলেটি। ক্রমশ তার পায়ের জাদু ছেয়ে ফেলে বহু ফুটবল ভক্তের মন। শুধু পায়ের জাদু বললে ভুল হবে, তার ব্যবহার, মাঠের আচরণ, সবকিছুই। বাকি খেলোয়াড়েরা যেখানে সুযোগ পেলেই প্লে-অ্যাক্টিংয়ের সাহায্য নেয়, সেখানে এই ছেলেটি একদম অন্যরকম! মার খাচ্ছে সমানে কিন্তু বারবার উঠে দাঁড়াচ্ছে, ওর পা থেকে বল কেউ কাড়তে পারছে না! ছেলেটি ভারী অদ্ভুত। মুখে কোনও বড়াই নেই! আমি সেরা, আমি সেরা বলে নিজেকে জাহির করার কোনও প্রয়োজন বোধ করে না সে! চুপচাপ নিজের খেলা দিয়েই সে জবাব দিতে চায়!
আরও শুনুন: ক্যাপ্টেনের আর্ম-ব্যান্ড দিলেন ইয়েডলিনকে, সবারে মান দিয়েই সম্মান ফিরে পান রাজা মেসি
কিন্তু ওই যে, কথায় বলে না, সবাইকে খুশি করা যায় না? মেসিও পারেনি। তাই তার মতো ওয়ান্স ইন আ লাইফটাইম প্লেয়ার-এরও হেটার্সের সংখা নেহাত কম নয়!
লোকটা বেঁটে। হেড দিতে পারে না। শুধু বার্সেলোনার প্লেয়ার। দেশের হয়ে খেলতে পারে না। লিডারশিপ নেই, ডান পায়ে জোর নেই! এরকম অসংখ্য কটাক্ষের তিরে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে লোকটা তার পুরো কেরিয়ার জুড়ে! সাত-সাতটা ব্যালন ডি’ওর জেতার পরও কিন্তু অবিসংবাদিতভাবে সর্বকালের সেরা বলে তাঁকে মানতে চাননি বহু ফুটবল বোদ্ধা! তাঁদের যুক্তি ছিল মারাদোনা পেলের পাশে জায়গা পেতে হলে অন্তত দেশকে ট্রফি দিতেই হবে। মেসি ২০২১-এ দেশকে কোপা দিলেন! ২৮ বছর পর দেশকে প্রথম ট্রফি দিলেন! কিন্তু তাতেও কি আর বোদ্ধাদের সন্তুষ্ট করা যায়! ৭টা ব্যালন ডি’ওর, ৬টা ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট, ৫টা আইএফএফএস প্লে-মেকার অফ দ্য ইয়ার হওয়ার পরেও, দেশকে ট্রফি দেওয়ার পরও… সর্বকালের সেরা বলে ঘোষিত হওয়ার পথে নতুন শর্ত হয়ে দাঁড়াল, বিশ্বকাপ!
আরও শুনুন: শুধুই কি আনন্দ দেওয়ার যন্ত্র! নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই রক্তমাংসের মেসির?
কে জানত শেষ লগ্নে এসে ফুটবলের বরপুত্রের জন্য এত বড় উপহার তুলে রেখেছেন ফুটবলের ভগবান! অতি বড় ভক্তরাও তো ভাবেননি। যে ২০২২ সালের ব্যালন ডি’ওর লিস্টের প্রথম ৩০ জনেই জায়গা পাননি, সেই সালই দিল বিশ্বকাপ! সময়ের কী অদ্ভুত খেলা, না! সারা কেরিয়ার জুড়ে যে ট্রফিটা ছোঁয়ার জন্য বারবার কাছে গিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে, রাগে ক্ষোভে দেশের হয়ে আর না খেলার মতো সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, সেই ট্রফিটাই অবশেষে ধরা দিল কেরিয়ারের শেষ লগ্নে! আর সেই ওয়ার্ল্ড কাপের সৌজন্যেই ৩০ অক্টোবর মেসির হাতে উঠল অষ্টম ব্যালন ডি’ওর। মনে পড়ে একবার জোহান ক্রুয়েফকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন, মেসি তাঁর কেরিয়ারে ৭-৮টি ব্যালন ডি’ওর জিতবেন। তাঁর কথা যে এভাবে সত্যি করে দেবেন মেসি, সেটাও কি অতি বড় মেসি সমর্থকরা ভেবেছিলেন! আসলে দর্শক পালটে যায়, সতীর্থ পালটে যায়, জার্সিও বদলায়, কিন্তু মেসি পালটান না! হয়তো শেষবারের মতোই, তাঁর হাতে ফুটবল বিশ্বের এই সর্বোচ্চ সম্মান উঠল। আর তাই এবারের উদযাপনও হল একটু অন্যভাবে! সময় যেমন অসীম, মেসিও যেন ঠিক তেমনিই। আর তাই তো ব্যালন ডি’ওর-এর মঞ্চে ফুটে উঠল-
‘মেসি ইজ ইনফিনিটি’!
সত্যিই, ‘ইনফিনিটি’ এই তকমা আর কাকেই বা এমন মানায়!