জার্সি বদলে যায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। পালটে যায় মন, পালটায় বিশ্বাস। তবুও কি সব বদলে যায়? জার্সির গায়ে লেগে থাকা গল্পেরা কোথায় যায় তাহলে? সেই গল্পই শোনালেন শঙ্খ বিশ্বাস।
জার্সি কোনও পোশাক নয়, জার্সি আসলে একটা দেশ। জার্সি কোনও পোশাক নয়, জার্সি আসলে একবুক আবেগ। একটা জার্সিই তাই হয়ে উঠতে পারে প্রজন্মের ইশতেহার। স্বপ্নের শামিয়ানা। জার্সি পরে কেউ তো কখনও একা হয়ে যায় না। জার্সি পরে কেউ ডুবে যেতে পারে না ব্যক্তির অহংকারে। জার্সির সুতোয় মিশে থাকে সমষ্টির টান। জার্সির গায়ে লেখা থাকে লড়াইয়ের অঙ্গীকার। জার্সি তাই কোনও পোশাক হতে পারে না। জার্সি আসলে স্বপ্ন ছোঁয়ার অসীম দুঃসাহস।
আরও শুনুন: সনাতন ধর্মের ভিত্তিতে এক হোক দেশ, লক্ষ্যে ১০৮ ফুটের শঙ্করাচার্য মূর্তি প্রতিষ্ঠা মধ্যপ্রদেশে
সেই জার্সিও বদলে যায়। রঙ বদলায়, নকশা বদলায়। আর জার্সির গায়ে লেগে থাকা গল্পগুলো! তারাও কি বদলে যায় একেবারে? যে জার্সি ইতিহাস গড়ে, তার কথা আলাদা। তা হয়তো তোলা থাকে অভিজাত কোনও মিউজিয়ামে। আর যে জার্সি স্বপ্নের গন্তব্য থেকে সামান্য দূরত্বেই শেষ করে ফেলে তার জার্নি, তার ঠাঁই হয় কোথায়! আর সেই সব জার্সি বুকে জড়িয়ে যারা জীবনের এক্কাদোক্কা খেলতে খেলতে কোনওক্রমে এগিয়ে যায়, তাদের গল্পগুলোই বা কে মনে রাখে! জার্সি তাই শুধু পোশাক নয়, কখনও সে বিজয়কেতন, কখনও যেন কেটে যাওয়া কোনও ঘুড়ি।
দিন বদলালে, জার্সিকেও বদলে যেতে হয়। এই যেমন বদলাচ্ছে টিম ইন্ডিয়ার জার্সি। নতুন এই জার্সি পরেই হয়তো দেশের হয়ে ৩ নং বিশ্বকাপ জিততে দেখা যাবে রোহিত-বিরাটদের। গোটা দেশের প্রত্যাশার ভার কাঁধে নিতে হয় বলেই হয়তো এবার চিরাচরিত নীল রঙের জার্সির কাঁধে যোগ করা হয়েছে তেরঙ্গা।
১৯৭৫ সালে ক্রিকেটে পথ চলা শুরু ভারতের। ১৯৮৭ অবধি, সাদা জার্সিতেই মাঠ কাঁপিয়েছেন কপিল-সুনীল-জিমিরা। ভারতীয় ক্রিকেটে প্রথম আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে ১৯৮৫ সালে। প্রথমবারের জন্য রঙিন জার্সিতে দেখা যায় ভারতীয় খেলোয়াড়দের। হলুদ আর আকাশির মিশেলে তৈরি সেই জার্সির অবশ্য কোনও স্পনসর ছিল না। ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের সব থেকে সাদামাটা রঙিন জার্সি এটি। এরপর ১৯৯০ বিশ্বকাপে আবার বদল হয় জার্সি। এবার তার রং বদলে হল গাঢ় নীল। ১৯৯৬-এ আবার ফিরল আকাশি নীল আর হলুদের মিশেল। এই ভাবে ১৯৯৯, ২০০৩, ২০০৭, ২০১১, ২০১৫, ২০১৭- বদলে বদলে গিয়েছে জার্সিরা। ২০১৯-এর পর তো প্রতি বছরই বদলায় জার্সি।
আরও শুনুন: পড়েছিল ধোনির মারা ‘উইনিং সিক্স’! নিলামে উঠছে গ্যালারির সেই বিখ্যাত দুই সিট
বদলের কথা হচ্ছেই যখন, এই সুযোগে একটি ছেলের গল্প করি? সবে খেলা বুঝতে শিখছে ছেলেটা। খেলার সুযোগ পেলে তাকে আর পায় কে! বাবার মুখে মারাদোনা, রিচার্ডস, গাভাস্কার, অমরনাথদের গল্প শোনা ছেলেটার আগ্রহ যত দিন গেল বেড়েই চলল। তখন সে জার্সি বলতে বুঝত শুধু ওই নীল-হলুদ জার্সিকে। ১৯৮৩-র পর যখন প্রথমবারের জন্য বিশ্বকাপ ফাইনালে পৌঁছল ইন্ডিয়া, ছেলেটি তখন মোটে বছর দশের। সেদিন হারের পর বাবার কিনে দেওয়া জার্সিটাকে জড়িয়ে খুব কেঁদেছিল ও।
২০০২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে অদ্ভুত চুলের, দাঁত উঁচু, আধখানা নেড়ামাথা একটা লোকের খেলা দেখে সে-ই অবাক হয়ে গেল। বাবার কাছে শুনল, ওর নাম রোনাল্ডো। ব্যাস, ফুটবল আর সেই লোকটাকে ভালোবেসে ফেলল। সঙ্গে ভালোবাসল সেই হলুদ-সবুজ জার্সিটাকেও, নিজের অজান্তেই। এই জার্সি প্রীতি কিন্তু খুব ছোঁয়াচে, যার হয় সে-ই জানে। এর পর ধীরে ধীরে সবুজ-মেরুন, ম্যানচেস্টারের লাল-সাদায় মন মজল তার।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে বদলে গেল সেই ছেলেটাও। হঠাৎ করেই ভালোবেসে ফেলল কাতালুনিয়া ক্লাব বার্সেলোনাকে। আদ্যোপান্ত ব্রাজিল ফ্যান হয়েও সে প্রেমে পড়ল এক আর্জেন্টাইন জাদুকরের। মনে প্রাণে চাইল তাঁর শেষ বিশ্বকাপের শিরোপা উঠুক তার ভগবানের মাথায়, বিশ্বকাপ পাক ব্রাজিলের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনা।
অবাক হচ্ছেন? কেন, কথাতেই তো বলে, in life, change is the only constant! অর্থাৎ জীবনে পরিবর্তনই একমাত্র ধ্রুবক, একমাত্র সত্য। এই যে, ঠিক যেমন জার্সি বদলে গেল টিম ইন্ডিয়ার। রোজ তো কত কিছুই বদলাতে দেখছি আমরা! ইন্ডিয়াও তো শুনি বদলে যাচ্ছে।
আরও শুনুন: ক্যাপ্টেনের আর্ম-ব্যান্ড দিলেন ইয়েডলিনকে, সবারে মান দিয়েই সম্মান ফিরে পান রাজা মেসি
তবে সত্যি কি কেউ বদলায়! বদলানো যায় ছোটবেলার ভালোবাসা? নিত্যদিনের কাজের চাপ, অফিসকাছারি, সংসার, ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের চিন্তায়- দামাল দস্যিপনার দুড়দাড় যে লুকিয়ে ফেলেছে যত্ন করে। যার গায়ে লেগে পুরনো বিকেলের আলো। মাঠের ধুলোর গন্ধ সে কি সত্যিই বদলায়?
ওই যে, যে ছেলেটির গল্প বললাম, সে কিন্তু বদলায়নি। তাই তো তার কাছে ২০০৩-এর ক্রিকেট বিশ্বকাপ ফাইনালে হারের দাগটা আজও দগদগে। তাই তো আজও ওই হলুদ-সবুজ জার্সির গুরুত্ব তার কাছে অনেক অনেক বেশি। তাই তো আজ মিয়ামির জার্সি পরলেও বার্সেলোনার একটা খেলাও সে মিস করে না।
সময় পালটায়, মানুষের অভ্যেস পালটায়, দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়, জার্সি বদলে যায়। তবুও পুরনো দিন, পুরনো স্মৃতি যেন ওই ছোট বাতিল হয়ে যাওয়া জার্সির ভাঁজে ভাঁজেই গুটোনো থাকে। আসলে জার্সি পালটায়, তবু জার্সি ফেলে দেওয়া যায় না।