শচীন-কাম্বলি থেকে বর্তমানের যশ-পৃথ্বীর উদাহরণ বোধহয় আমাদের এই একটা কথাই বরাবর মনে করিয়ে দেয়। প্রতিভার কোনও শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি হয় না। যা হয়, তা হল নিজেকে চিনতে পারা আর ধরে রাখতে পারার ক্ষমতা। যিনি পারেন, ইতিহাস তাঁকেই মনে রাখে।
দেখা হল দুই বন্ধুর। দেখা হল ‘গুরুপূর্ণিমা’য়। একজন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। জীবনের মারে অনেকটাই যেন বিধ্বস্ত। আর একজন যেন জীবনকে এনেছেন নিজের বশে। সাফল্যের আলো এখনও ঝলমল করছে তাঁর সর্বাঙ্গে। বন্ধুত্বের মধ্যে হয়তো দূরত্ব থাকে না। তবু শচীন তেন্ডুলকর আর বিনোদ কাম্বলির মধ্যে দূরত্ব যদি কিছু থেকে থাকে, তবে তার নাম দেওয়া উচিত শৃঙ্খলা।
ভারতীয় ক্রিকেটের এ যেন এক ক্ল্যাসিক উত্থান-পতনের দৃষ্টান্ত। দুই বন্ধুই দারুণ প্রতিভাবান। সেন্ট জেভিয়ার্সের বিরুদ্ধে, সারদাশ্রম বিদ্যামন্দিরের হয়ে তাঁদের জুটিতে করা ৬৬৪ রানের ইনিংস নিয়ে এখনও চলে চর্চা। কাম্বলি করেছিলেন ৩৪৯ রান, শচীন ৩২৬ রান। দু’জনেই থেকে গিয়েছিলেন অপরাজিত। সেই শুরুর বিন্দু থেকে একজন কেরিয়ার শেষ করলেন সাফল্যের এভারেস্ট স্পর্শ করে। অন্যজন সৃষ্টিছাড়া প্রতিভার স্বীকৃতি হয়েই যেন রয়ে গেলেন। আপশোস করে অনেকেই বলেন, কাম্বলির প্রতিভা তো কম ছিল না! শুধু নিজেকে যদি আর একটু শৃঙ্খলায় বেঁধে রাখতে পারতেন, তাহলে ভারতের ক্রিকেটার ইতিহাস বোধহয় অন্যরকম লেখা হত। আসলে, জীবন নিজেই নিজের ইতিহাস লেখে। আর সেই ইতিহাসেই দুই বন্ধুর অবস্থান চিহ্নিত হয়েছে একেবারে অন্য স্থানাঙ্কে।
ঠিক এই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি যেন পৃথ্বী শ আর যশস্বী জয়সওয়ালের গল্পেও। দু’জনেই কোচ জ্বলা সিংহের ছাত্র। দেশের অন্যতম প্রতিভাবান তরুণ ক্রিকেটার হিসাবেই কেরিয়ার শুরু করেছিলেন পৃথ্বী। শুধু ভারতীয় ক্রিকেট নয়, গোটা বিশ্বই চোখ রেখেছিল তরুণ এই ব্যাটারের দিকে। কেউ কেউ তাঁর তুলনা শুরু করেছিলেন, স্বয়ং শচীন তেন্ডুলকরের সঙ্গে। এত আশা জাগিয়েও কেমন যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলেন তিনি। এমনকী চলতি আইপিএল-এ দল পর্যন্ত পাননি। তাঁর থেকে কিঞ্চিৎ পরেই শুরু করেছিলেন যশস্বী। যশ-ও এসেছে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। তবু মাথা ঘোরেনি তরুণ ব্যাটারের। যশ সামলে নিজের কেরিয়ারকেও যে সামলে রাখতে পারেন, তা প্রমাণ করেছে পারথ টেস্ট। নায়ক হিসাবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যশস্বী। এবং আগামী দিনে, দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ যে অনেকটা তাঁর কাঁধেই, এ নিয়ে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি নিশ্চিত।
জীবনের এই গল্পের ভরকেন্দ্র রাখা শৃঙ্খলাতেই। প্রতিভা ঈশ্বরপ্রদত্ত। তবে তাকে লালন করতে হয়। অন্তরে পালন করতে হয়। শ্রমের আগুনে পুড়িয়ে খাঁটি করে তুলতে হয়। আর তার জন্য এক ও একমাত্র দরকার শৃঙ্খলা। নিজেকে শাসন করার ক্ষমতা। একহাতে নিজের জন্য চাবুক ধরে না থাকলে, অন্য হাতে সৃষ্টির ফুল ফোটানো সম্ভব নয়। যে কোনও সৃষ্টিশীল মানুষের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। শচীন যেভাবে নিজের জন্য নিজেই রচনা করেছিলেন শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি, তার তুলনা মেলা ভার। দীর্ঘ কেরিয়ার। এসেছে চোট-আঘাত। কিন্তু প্রতিবার অদম্য এক আত্মবিশ্বাসে সে চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনি। তা কোনও ঐশী ক্ষমতাবলে সম্ভব হয়নি। শচীন তা সম্ভব করে তুলেছেন প্রতিভা আর শৃঙ্খলার যুগলবন্দিতেই। এই তো ক’দিন আগের কথা। হাস্যকর ভাবে আউট হচ্ছিলেন বিরাট কোহলি। নিজেই নিজের টাইমিং দেখে হতবাক হচ্ছিলেন। অনেকে তো প্রায় ধরেই নিয়েছিলেন, রাজা কোহলির রাজত্বের অবসানের দিনক্ষণ এসে গিয়েছে। সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন তিনি। সাফল্যের একটি বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আবার নতুন করে নিজেকে শৃঙ্খলায় মুড়ে ফেলার গুরুত্ব বুঝলেন, এবং অন্যকে বোঝালেনও। যেমন ফুটবলবিশ্ব আক্ষেপ করে, রোনাল্ডনিহো যদি আর একটু শৃঙ্খলাপরায়ণ হতেন! যেমন শৃঙ্খলায় নিজেকে বেঁধেছিলেন ৯ নম্বর জার্সির রোনাল্ডো, চোট সারিয়ে এসে বিশ্বকাপ মাতিয়ে দিয়েছিলেন। যেমন শৃঙ্খলার পাঠ শেখান লিওনেল মেসি বা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো।
সম্প্রতি এই শৃঙ্খলার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন শচীন নিজেও। গুরুর কাছে কী শীখেছিলেন তিনি? শিখেছিলেন, নিজের কিট-কে শ্রদ্ধা করতে। গুরু তাঁকে বলে দিয়েছিলেন, কখনও নিজের ব্যর্থতার জেরে ব্যাট ছুড়ে ফেলতে নেই। ওই ব্যাট-ই একমাত্র অবলম্বন, যার জন্য একজন ক্রিকেটার ড্রেসিংরুমে বসে থাকার যোগ্যতা অর্জন করেন। তাই কোনোদিন যেন নিজের কিটের প্রতি কেউ অশ্রদ্ধা প্রকাশ না করেন। আজীবন সে কথা মেনে চলেছেন শচীন। এবং গুরুর কথামতো, সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন তরুণ ক্রিকেটারদেরও। কিন্তু এর সঙ্গে শৃঙ্খলার কী সম্পর্ক? আসলে এই জীবনের এই সহজপাঠের মধ্যেই শৃঙ্খলার প্রথম পাঠ। এই হল আত্মশাসনের, নিজের সৃষ্টি ও কর্মকে শ্রদ্ধা করার প্রথম চিহ্ন। তা অর্জন করতে হয়। গুরু হয়তো পথের দিশারী। তবে পথের দাবিতে সকলকেই রপ্ত করতে একলা চলো-র মন্ত্র। আর সে মন্ত্রে শৃঙ্খলাই বোধহয় একমাত্র বন্ধু।
শচীন-কাম্বলি থেকে বর্তমানের যশ-পৃথ্বীর উদাহরণ বোধহয় আমাদের এই একটা কথাই বরাবর মনে করিয়ে দেয়। প্রতিভার কোনও শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি হয় না। যা হয়, তা হল নিজেকে চিনতে পারা আর ধরে রাখতে পারার ক্ষমতা। যিনি পারেন, ইতিহাস তাঁকেই মনে রাখে। অন্যজনের জন্য সম্বল বিস্মৃতি, এই রূঢ় সত্যির কোনও বিকল্প নেই।