‘রাজার মুকুট রাজার সাজ/ অন্য কেউ তা পরবে আজ’… খেলার নিয়ম এমনই। সেখানে সেরার আসন জুড়ে একজনই থেকে যেতে পারেন না কখনও। একদিন যিনি পুরোনোকে পিছনে ফেলেছিলেন, আগামীকে কুর্নিশ করে তাঁকেও সরে যেতে হয় একদিন। পুরোনো থেকে নতুনের হাতে ব্যাটন বদল হয় ক্রমাগত। আরও একবার, সেই মহাকাব্যিক পরম্পরার সাক্ষী হয়ে থাকল উইম্বলডন। অপ্রতিরোধ্য নোভাক জকোভিচের রাজ্যপাটে পাকাপাকিভাবে ভাগ বসিয়ে ফেললেন তাঁর থেকে পাক্কা ষোল বছরের ছোট স্প্যানিশ তরুণ, কার্লোস আলকারাজ।
২০১৭ সালের পর থেকে টানা ২৮ ম্যাচ। কেউ আঁচড় কাটতে পারেনি তাঁর সাম্রাজ্যে। তার উপরে প্রথম সেটেই কার্যত উড়িয়ে দিয়েছিলেন উলটো দিকের সদ্য-সাবালক তরুণকে। টেনিস-বিশ্ব দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, প্রথম সেটে জিতলে জোকারকে হারানো কেবল মুশকিলই নয়, না-মুমকিন। কিন্তু বিশ্বাসে পরিণত হওয়া সেই মিথকেই এবার সপাট ব্যাকহ্যান্ডে মাঠের বাইরে ফেলে দিলেন আলকারাজ। আর তার সঙ্গে আরও একটা মিথকেও স্রেফ উড়িয়ে দিলেন। ফেডেরারের কাব্যিক টেনিস, নাদালের আগ্রাসী লড়াই আর জকোভিচের রোবটপ্রতিম নির্ভুল সার্ভ দেখা চোখেরা এতদিন বিশ্বাস করতেই পারছিল না, এই তিন মহারথীর সঙ্গে এক সারিতে আর কেউ উঠে আসতে পারে। কিন্তু ব্রিটেনের যুবরানির হাত থেকে স্বপ্নের ট্রফিটা তুলে নিয়ে কার্লোস আলকারাজ বুঝিয়ে দিলেন, কোর্ট শাসন করার জন্য হয়তো এসে গিয়েছেন নতুন রাজা।
আরও শুনুন: শুধুই কি আনন্দ দেওয়ার যন্ত্র! নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই রক্তমাংসের মেসির?
১২ বছর বয়সে একটা ছোট্ট সাক্ষাৎকারে সেদিনের জুনিয়র প্লেয়ার কার্লিতো বলেছিলেন, ভবিষ্যতে পেশাদার টেনিস খেলোয়াড় হলে দুটো ট্রফি জিততে চান তিনি। একটা ফরাসি ওপেন আর একটা উইম্বলডন। মাস দেড়েক আগে প্রথম স্বপ্নটার দোরগোড়ায় পৌঁছেও জিততে পারেননি। রোলাঁ গারোঁ-র ক্লে কোর্টে সেদিন তরুণের স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছিলেন এই নোভাক জকোভিচ-ই। সুতরাং কার্লোসের কাছে উইম্বলডন বোধহয় ছিল পালটা মার ফিরিয়ে দেওয়ার সুযোগ। যেখানে জেতার পর খোদ জকোভিচ সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, এতদিন সুরকির কোর্ট বা কখনও কখনও হার্ড কোর্টে প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলছিলেন আলকারাজ। কিন্তু এখন ঘাসের কোর্টের সঙ্গেও নিজেকে অভ্যস্ত করে ফেলেছেন তিনি। জকোভিচের কি মনে পড়ছে, একসময় নাদালেরও এই সমস্যা ছিল? নাদাল-কে ক্লে কোর্টের কিং বলা হলেও, ঘাসের কোর্টের রাজার মুকুট অবিসংবাদিতভাবে ছিল ফেডেরারের মাথাতেই। কিন্তু নিজেকে ঘষামাজা করতে করতেই ঘাসের কোর্টে ছন্দ খুঁজে নিয়েছিলেন রাফা। ২০০৬ সালে যিনি ছিলেন উইম্বলডনের ফাইনালের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়, এই ২০২৩-এ এসে তাঁরই জুতোয় পা গলিয়েছেন তাঁর ভাবশিষ্য আলকারাজ। আর শুধু পা গলিয়েই থামেননি, টানা চারবার উইম্বলডন জেতা জোকারকে হারিয়ে ট্রফিও তুলে নিয়েছেন কার্লিতো। বুঝিয়ে দিয়েছেন, কেবল শীর্ষ বাছাই হয়ে থেমে যাওয়া তাঁর স্বভাব নয়। ২৩ বারের গ্র্যান্ড স্লাম জয়ী, বিয়র্ন বর্গ-এর রেকর্ড ছুঁতে চলা জকোভিচের দুরন্ত আক্রমণ আর পাকা রক্ষণের সামনে মুখ থুবড়ে পড়েও তিনি ফের উঠে দাঁড়াতে জানেন। জানেন লড়াইয়ে ফিরে আসতে। প্রথম সেট ১-৬, আলকারাজকে দাঁড়াতেই দেননি জকোভিচ। পরের সেটে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শেষে জয় ছিনিয়ে নিয়ে যেন আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলেন আলকারাজ। তৃতীয় সেটে রোখা যায়নি তাঁকে। কিন্তু তারপরেও তো উলটো দিকের র্যাকেট হাতে লোকটার নাম জোকার। ব্যাটম্যানের জোকারের মতোই যে নির্বিকার হাসিমুখে বিপক্ষকে নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে। তাই চতুর্থ সেট জিতে প্রবল ভাবে ম্যাচে ফিরলেন নোভাক জকোভিচ। ম্যাচের আগেই যিনি বলে দিয়েছিলেন, ফাইনালে ১০ বছর বয়স কমিয়ে তিনি খেলতে নামছেন, তিনি শেষ পর্যন্ত শরীর মনের জোর ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। এর আগে অনেকবারই লম্বা সময় ধরে চলা পাঁচ সেটের খেলায় স্ট্যামিনার ঘাটতির জন্যই নোভাকের সঙ্গে পেরে ওঠেননি অনেকে। ফ্রেঞ্চ ওপেনের সেমিফাইনালে যে অবস্থায় পড়েছিলেন আলকারাজ নিজেও। কিন্তু আলকারাজ এবার আর অভিমন্যু হতে আসেননি। অনবদ্য ডিফেন্সে তিনি জকোভিচের আক্রমণ রোখার উপায় শিখে নিয়েছেন। দম ধরে রাখার তাড়াহুড়োয় যে জকোভিচ দ্রুত পয়েন্ট শেষ করতে চাইছিলেন, তাঁকে পালটা ধৈর্য দিয়েই মাত করলেন অনুজ খেলোয়াড়। বড় র্যালিতে জকোভিচ যখনই তাঁকে বেসলাইনে আটকাতে চেয়েছেন, সেখান থেকেই মোক্ষম ড্রপ শট মেরে বল নেট পার করে দিয়েছেন আলকারাজ, যা ছুটে এসে আর ফেরাতে পারছিলেন না জকোভিচ। বেস লাইন থেকে দুর্দান্ত গতির রিটার্ন, ফোরহ্যান্ড আর ব্যাকহ্যান্ডের কিছু অবিশ্বাস্য ক্রসকোর্ট শট, সব মিলিয়ে জোকারকে আনফোর্সড এরর করতে বাধ্য করিয়েছেন আলকারাজ। বছর দুই আগে মাদ্রিদে নাদাল আর নোভাক দুজনকেই হারিয়েছিলেন যে আঠেরোর তরুণ, এবার তিনি আরও পরিণত। চিরকালের নির্লিপ্ত জোকারকে তিনি বিরক্ত হতে, অধৈর্য হতে বাধ্য করলেন। অতিমানব জোকারের মধ্যে থেকে বের করে আনলেন সেই আবেগ, যে আবেগ টেনিসের হাড়ে মজ্জায় জড়িয়ে আছে। যে আবেগে নাদালের কাছে মুকুট হারিয়ে কেঁদে ফেলেন ফেডেরার। যে আবেগে শেষ ম্যাচে আগাসির চোখ জলে ভরে আসে। টেনিস কোর্ট বরাবরই বড়ো আবেগী। গত কয়েকটা বছর ধরে সেই আবেগ তার ধারা হারিয়েছিল নিরাসক্ত স্কিল আর রোবোটিক গেমের আগ্রাসনে। সৌজন্যে একজনই, নোভাক জকোভিচ। আলকারাজ শুধু উইম্বলডনেই ফুল ফোটালেন না, জকোভিচের সেই আবেগহীনতার পাথর ভেঙে টান দিলেন তাঁর ভেতরের একান্ত সংগোপন আবেগের ধারাতেই। হয়তো এই প্রথমবার, জোকারের চোখে জল দেখল টেনিসবিশ্ব।
আরও শুনুন: জেতার সুযোগ পেয়েও সুবিধা নেননি! মানুষকে অন্য শিক্ষা দিয়েছিলেন দৌড়বিদ
২০০২ সালে উইম্বলডন জিতেছিলেন লেটন হিউইট। তারপর থেকেই টেনিস দুনিয়ায় মহাত্রিভুজের রাজত্ব শুরু। ২০০৩ থেকেই উইম্বলডনের রাজার রাজা ফেডেক্স। ২০১২ সালে ঠিক এই দিনেই, পিট সাম্প্রাসের সবথেকে বেশি সপ্তাহ ধরে ১ নম্বরে থাকার রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিলেন রজার ফেডেরার। গোটা বিশ্বের আপামর টেনিসপ্রেমীর চোখের সামনে মাঠ জুড়ে কবিতা লিখেছিলেন সুদর্শন সুইস তরুণ। আবার অনতিবিলম্বেই দুরন্ত আগ্রাসন আর ছটফটে ছেলেমানুষি নিয়ে রজারের সঙ্গে পাল্লা দিতে উঠে এলেন রাফা। আর তারপরে কম্পিউটারের মতো নিখুঁত আর যুক্তিনির্ভর টেনিস নিয়ে জকোভিচের আগমন। ব্যস, আর কারও প্রবেশাধিকার মেলেনি এই সাম্রাজ্যে। ফেডেরারের ২০, নাদালের ২২ ও জকোভিচের দখলে এসেছে ২৩টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম। গত ২০ বছর ধরে টেনিস বিশ্বকে শাসন করেছেন এই তিন মহারথী। আস্তে আস্তে বয়স বেড়েছে। মাঠ থেকে বিদায় নিয়েছেন ফেডেরার। নাদালও অস্ত যাওয়ার পথে। একা কুম্ভ হয়ে গড় রক্ষা করে চলেছিলেন জোকার। এবার তাঁকেও হয়তো বিদায়ের বার্তা শুনিয়ে দিলেন আলকারাজ। আলকারাজ, মেডভেদেভ, রুনদের পৃথিবীতে এবার হয়তো জোকারও বৃদ্ধ হলেন।