ব্যাট-প্যাড তুলে রেখেছেন বহুদিন। তবু আজও তিনি মিঃ ডিপেন্ডেবল। ক্রিকেটপ্রেমীদের দীর্ঘদিনের দাবি অবশেষে পূরণ হতে চলেছে। ফের ভারতীয় ক্রিকেটের হটসিটে রাহুল দ্রাবিড়। কোন মন্ত্রে আজও তিনি অতন্দ্র প্রহরী? জানালেন, অর্পণ গুপ্ত।
শ্রীলঙ্কা সফরে ভারতের কোচ হিসেবে মিডিয়ার সামনে আসছেন স্বয়ং রাহুল দ্রাবিড়। স্রেফ এইটুকু খবর টুইট করেছিল বিসিসিআই। সেই মুহূর্ত থেকেই টুইটারভেসে গেলহাজার হাজার মানুষের শুভেচ্ছাবার্তায়। প্রায় সকলেরইবক্তব্য,ভারতের জাতীয় দলের দায়িত্বে তাঁরা দেখতে চান মিস্টার ডিপেন্ডেবল-কে। কিন্তু যে মানুষটাপ্রায় দশবছর আগে পাকাপাকিভাবে তুলে রেখেছেন নিজের ব্যাটখানা,তাঁর শরীরে লেগে থাকা ‘মিঃ ডিপেন্ডেবল’ তকমা কি আজও প্রাসঙ্গিক? নাকি ভূমিকা বদলের সঙ্গেসেই বল্কলে লেগেছে নতুন রং?
দ্রাবিড়নিজে অবশ্যএসব থেকে কয়েক মাইল দূরে। যেন অন্যগ্রহের মানুষ। প্র্যাকটিসে টিপস দিচ্ছেন তরুণ ক্রিকেটারদের। সযত্নে নিজেকে আড়াল করে রাখছেন ক্যামেরার যাবতীয় ঝলকানি থেকে। প্রেস কনফারেন্সে বলছেন যে,এই সফরে তিনি নিজেও এসেছেন শিখতে। নিজের জ্ঞানকে পরিশীলিত করতে। সাংবাদিক থেকে শুভানুধ্যায়ীর শুভেচ্ছাটুকু তুলে নিচ্ছেন মেপে মেপে। বাড়তি প্রশংসা বা প্রশস্তিবাক্যকে সযত্নে দূরে রাখছেন। দ্রাবিড়ীয় পৃথিবীর এ এক নিজস্ব ছন্দ।
দিনকয়আগেই বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ঘোষণা করেন যে,জুলাইতে আসন্ন শ্রীলঙ্কা সফরে ভারতীয় দলের হেড কোচ হিসেবে থাকবেন তাঁরই এককালের সতীর্থ দ্রাবিড়। শ্রীলঙ্কায় দ্রাবিড়ের কোচিং ও শিখর ধাওয়ানের অধিনায়কত্বে তিনটি ওয়ান ডে ও তিনটে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলবে ভারতীয় দল।
এই প্রথমবার বিশ্বের দুই প্রান্তে দুটি ভারতীয় দল একইসঙ্গেমাঠে নামবে। ইংল্যান্ডে রবি শাস্ত্রীর কোচিং ও বিরাট কোহলির অধিনায়কত্বে যেমন ভারত নামবে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৫ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলতে তেমনই দ্রাবিড়-ধাওয়ানের ভারত শ্রীলংকায় খেলতে নামবে একই সময়ে।
দীর্ঘদিন ধরেই দ্রাবিড়কে ভারতীয় দলের দায়িত্বে নিয়ে আসার দাবিউঠছিল বিভিন্ন মহল থেকে; আন্তর্জাতিক মঞ্চে গত দু-তিনবছর ধরে ভারতের যে রিজার্ভ বেঞ্চের শক্তি তার পিছনে রয়েছে দ্রাবিড়ের নিরলস পরিশ্রম। বেঙ্গালুরুতেন্যাশানাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে তরুণ ক্রিকেটারদের তালিম দেওয়া থেকে ‘ইন্ডিয়া-এ’ও অনুর্দ্ধ উনিশ ভারতীয় দলের দায়িত্ব সামলেছেন দ্রাবিড়। তাঁর কোচিং-এই উঠে এসেছেন ঋষভ পন্থ, ওয়াশিংটন সুন্দর, শুভমান গিল, মায়াঙ্ক আগরওয়াল, সাইনি, সিরাজের মতো উঠতি তারকারা। ২০১৬ ও ২০১৯ অনুর্দ্ধ ঊনিশ বিশ্বকাপে এঁরা পেয়েছেন দ্রাবিড়ের সান্নিধ্য। পাকিস্তানের কিংবদন্তিক্রিকেটার ইনজামাম উল হক এক সাক্ষাৎকারে জানান যে,শুধু টেকনিক নয়,দ্রাবিড় যে-কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাঁর নিজের যে মানসিক কাঠিন্য তাকেই চারিয়ে দিতে পারেনতরুণদের মধ্যে। অস্ট্রেলিয়া সিরিজে ঐতিহাসিক কামব্যাকে ভারতের তরুণ প্রজন্মের এই উত্থানের পিছনে তাই থেকে গেছে দ্রাবিড়ের অদৃশ্য হাত। সেই অন্তরালে থাকা দ্রাবিড়কে এবার যেন নিয়ে আসা হল ভারতীয় ক্রিকেটের হটসিটে।
মহেন্দ্র সিং ধোনি জমানার পর ধারাবাহিক ভালো ক্রিকেট খেলার নজির রাখলেও বারে বারে বিশ্বক্রিকেটের সর্বোচ্চ মঞ্চে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে রথের চাকা বসে যাচ্ছে বিরাট কোহলির দলের। অনিল কুম্বলে যখন ভারতীয় দলের দায়িত্ব থেকে সরে গিয়েছিলেন,তখন কোচ হিসেবে দ্রাবিড়ের নাম উঠে আসে কিন্তু দ্রাবিড় নিজেই সে সময়ে রাজি হন নি এই গুরুদায়িত্ব নিতে। কারণ হিসেবে পারিবারিক সমস্যা জানালেও হয়ত এর পিছনে ছিল সেই চেনা দ্রাবিড়ীয় দর্শন। নিজেকে শিক্ষিত করার জন্য তিনি বেছে নেন এন সি এ-এর দায়িত্ব। কোচ রবি শাস্ত্রীর হাতে ফের আসে দায়িত্ব। কিন্তু বিশ্বটেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল হারের পর ফের নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে শাস্ত্রীর কোচিং নিয়ে।
দ্রাবিড় ও শাস্ত্রীরদর্শনভিন্ন। শাস্ত্রীর বর্ণময় ইমেজের সামনে দ্রাবিড় প্রবলতম অন্তর্মুখী। সাক্ষাৎকারে দ্রাবিড় অকপটে বলেন যে তিনি যদি কোচ হন তাহলে অনুর্দ্ধ উনিশ বা ‘ইন্ডিয়া এ’দলের সঙ্গেযাওয়া কোনো খেলোয়াড়কে সুযোগের অভাবে বসে থাকতে হবে না। প্রত্যেকটি খেলোয়াড়কে তিনি সুযোগ দেবেন নিজের প্রতিভা মেলে ধরার। সুযোগপেলেইথেকেই উঠে আসবে ভবিষ্যতেরতারকারা। এছাড়া দ্রাবিড়ের কোচিং-এরআরেকটি বৈশিষ্ট্য হল ট্রেনিং শিডিউল। মাঠ ও মাঠের বাইরে প্রতিটি খেলোয়াড়ের গতিবিধির ওপর নিঃশব্দে নজর রাখেন ‘দ্য ওয়াল’, নিয়ন্ত্রিত জীবন আর অদম্য পরিশ্রমের ভেতরেই দ্রাবিড় মুড়ে রাখেন তাঁর যাবতীয় ক্রিকেটীয় প্রজ্ঞা। শাস্ত্রী,ল্যাঙ্গার কিংবা ফ্লেমিং-এর কোচিং পদ্ধতির থেকে যা একেবারেই আলাদা। ২০২৩ সালের আসন্ন বিশ্বকাপের কথা মাথায় রেখেই কি তবে ভারতীয় ক্রিকেটের মসনদে আনা হল ভারতীয় ক্রিকেটের অতন্দ্র প্রহরীকে?
বিরাট-রোহিতদের প্রতিবার ফাইনাল বা সেমিফাইনালে হারের ময়না তদন্তে যে মানসিক চাপ না নিতে পারার কথা উঠে আসছে বিভিন্ন মহল থেকে দ্রাবিড় সেখানে হয়ত হতে পারেন মুশকিল আসান। ভারতীয় ক্রিকেটের টালমাটাল সময় যে প্রতিটি আন্দোলনেই খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরতে চায় সেই দ্রাবিড়কেই, আজও।
‘দ্য ওয়াল’ উপমা এখানে বহমান। বিভিন্ন ভূমিকায় সে সমান প্রাসঙ্গিক। ইগো সমস্যা, তারকা ক্রিকেটারদের সাথে মানিয়ে নেওয়ার প্রসঙ্গে অবশ্যই থেকে যায় অনেক প্রশ্নচিহ্ন। অতীতে অনিল কুম্বলে অধ্যায় সুখকর হয়নি ভারতীয় দলের জন্যে। তাই এবার আগাম সতর্ক বোর্ড কর্তারা। আপাতত শাস্ত্রীই হয়ত থাকছেন ভারতের জাতীয় দলের দায়িত্বে; কিন্তু আসন্ন শ্রীলঙ্কা সফরে যদি দ্রাবিড়ের কোচিং-এ সত্যিই ভালো ফল করতে পারে তরুণ ব্রিগেড তবে তা নিঃসন্দেহেই খুলে দেবে অনেক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জানলা!
দ্রাবিড় তাঁর নিজস্ব পৃথিবীতে এখনও শুধু চেয়ে আছেন নেট প্র্যাকটিসের দিকেই। তাঁর পাখির চোখ আজও ক্রিকেট। বহির্বিশ্বের যাবতীয় প্রত্যাশাকে এতদিন ব্যাট হাতে নিজের মৌনতা দিয়ে শাসন করেছেন দ্রাবিড়, এবার তিনি নতুন ভূমিকায়। দ্রাবিড়ের সাফল্য মানে তো ক্রিকেটের এক ভিন্নদর্শনের জিতে যাওয়া, আর সেই সমস্ত সাফল্যর অর্জিত জহরত যে আখেরে জমা হবে ভারতীয় ক্রিকেটের সিন্দুকেই…।