তিনি ঈশ্বর। তিনি পৃথিবী। তিনি আমাদের ভালোবাসা। শচীন তেণ্ডুলকর। যে নামের সামনে নতজানু ভারতবাসী। আগেও ছিল, এখনও আছে। গোটা বিশ্ব যে বিস্ময় প্রতিভাকে স্মরণ করে সম্ভ্রমে। তাঁরই ৫০তম জন্মদিনে সংবাদ প্রতিদিন-এর আয়োজন ‘বাহ্ শচীন’। নিরলস সাধনায় যে সাধক দেশকে এনে দিয়েছেন অনন্ত ঐশ্বর্য, তাঁকেই ফিরে ফিরে দেখা স্বজন, সতীর্থদের চোখে। আসুন মেতে উঠি এই শচীন পার্বণে।
সুধীর গৌতম: ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় থেকে আমি শচীন তেণ্ডুলকরের ভক্ত। ক্রিকেটে আমার আগ্রহই জন্মেছিল শচীনকে দেখে। এখানে বলে রাখি, স্কুলে আমি ভালই ক্রিকেট খেলতাম। পরের দিকে আন্তঃকলেজ টুর্নামেন্টে এলএস কলেজের জন্য নির্বাচিতও হই। কিন্তু আমাকে খেলার কখনও সুযোগ দেওয়া হয়নি। উলটে একজন অন্তঃপ্রাণ ভক্ত হিসেবে শচীন স্যরের সঙ্গে দেখা করতে চাই বলায়, আমাদের গেমস টিচার একবার আমাকে উপহাসও করেছিলেন। ওঁর কোনও ধারণাই ছিল না শচীন স্যর আমার জীবনে কতটা জায়গা জুড়ে রয়েছেন। তবে এক এক সময় মনে হয়, অলক্ষে উনি আমার একটা বড় উপকারই করেছিলেন। মাস্টারকে আমি প্রথম দেখি ২০০২ সালে। কিনান স্টেডিয়ামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ওয়ান ডে খেলতে এসেছিলেন উনি। আমি সাইকেলে করে ম্যাচটা দেখতে গিয়েছিলাম। তার পর ২০০২ সালের জানুয়ারি মাসে ইডেন গার্ডেন্সে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মাস্টারের খেলা আমি দেখি। একই সিরিজে কানপুরের গ্রিন পার্কে আবার চতুর্থ ওয়ান ডে-টাও আমি দেখি। দিনটা এখনও মনে আছে– ২৮ জানুয়ারি। আর তখন থেকেই শচীন স্যরের সঙ্গে আমার সফরের শুরু।
আরও শুনুন: Sachin@50: দেবতাজ্ঞানে যাঁকে ভক্তি করি, তাঁর অধিনায়ক হওয়া ছিল স্বপ্নের মতো
প্রথম মাস্টার দর্শন
অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং ভারতকে নিয়ে ২০০৩ সালের ত্রিদেশীয় টিভিএস কাপে আমি মুম্বই গিয়েছিলাম। ওয়াংখেড়েতে চতুর্থ ওয়ান ডে দেখতে। ট্রাইডেন্ট হোটেলে ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়। উনি আমাকে বলেছিলেন, ওঁর বাড়ি যেতে। যাওয়ার পর উনি আমাকে বাড়ির ভেতর নিয়ে যান, জুস দেন খেতে। শুধু তাই নয়, শচীন স্যর আমাকে একটা জার্সির সঙ্গে খেলা দেখার জন্য ম্যাচের একটা টিকিটও দেন। আমার কাছে ব্যাপারটা স্বপ্নপূরণের মতো ছিল। ওঁর বাড়ি থেকে বেরনোর সময় উনি আরও জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, আমি আরও খেলা দেখতে চাই কি না?
পরের ম্যাচটাই ছিল নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে। কটকে। আমি মাঠের ভেতরে লাফিয়ে ঢুকে ওঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষীরা মাঠে ঢুকে আমাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। শচীন স্যর নিরাপত্তারক্ষীদের বলেন যে, আমাকে না মারতে। আমাকে ছেড়ে দিতে।
পরের ম্যাচ ছিল অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে। যা দেখতে আমি বেঙ্গালুরু যাই। চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে খেলাটা ছিল। কিন্তু সেই ম্যাচে শচীন স্যরের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। পরবর্তী ম্যাচ ছিল নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী স্টেডিয়ামে। শচীন স্যর সেঞ্চুরি করেছিলেন ম্যাচটায়। মনে মনে বলছিলাম যে, আমি শেষ ম্যাচে ওঁর সঙ্গে দেখা করি, ভারত হেরে গিয়েছিল ম্যাচটায়। এবার যেন সেটা না হয়। ভারত ম্যাচটা জিতেছিল শেষ পর্যন্ত। তাই আমি আবার লাফিয়ে মাঠের মধ্যে ঢুকে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। কিন্তু সেবার ধরা পড়ে যাই আমি। পুলিশ আমাকে সেকেন্দ্রাবাদ থানায় নিয়ে যায়। রাতে ছাড়ার আগে ভালরকম মারধরও করে। যার পর আমি ইডেনে ফাইনাল দেখতে যেতে পারিনি। ভারত যে ম্যাচটা হেরে গিয়েছিল।
Sachin@50: শচীনের সঙ্গে মিল মূল্যবোধে, জন্মদিনের উদযাপনে জানালেন অঞ্জলি
আমি ফের মুম্বই যাই। শচীন স্যরের সঙ্গে দেখা করতে। এবার উনি আমাকে বেশ বকুনি দিয়ে বলেন যে, মাঠের মধ্যে লাফিয়ে না ঢুকে পড়তে। যার পর আমি একবারই মাঠে ঢুকে পড়েছিলাম। ২০১০ সালে। হরভজন সিং যে দিন সেঞ্চুরি করেছিলেন নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে। আমেদাবাদে।
শরীরে রং করিয়ে তেণ্ডুলকরের ১০ নম্বর লেখা…
পড়াশোনা করতাম যখন, একমাথা চুল ছিল আমার। কিন্তু জামশেদপুর গিয়ে শারন শর্মার সঙ্গে আমার দেখা হয়। যে কিনা মাথা ভর্তি চুল রেখেও ভারতের ম্যাপ তাতে ডিজাইন করেছিল। আমি ঠিক করি, উলটোটা করব। চুল কামিয়ে ভারতের ম্যাপ আঁকাব, আর তাতে রং করব। আর প্রথম যখন আমি মুম্বইয়ে মাস্টারের সঙ্গে দেখা করতে যাই, পুরো শরীর রং করিয়ে গিয়েছিলাম। যাতে তেণ্ডুলকর ১০ লেখা ছিল। আগে আমি শুধু পিঠে তেণ্ডুলকর ১০ লিখতাম। কিন্তু ২০০৬ সালের পর সামনেও লেখা শুরু করি। ভারতের ম্যাপও তখন থেকে আমার সঙ্গে ছিল, যা কিনা ধীরে ধীরে আমার পরিচয়পত্র হয়ে গেল।
২০১১ বিশ্বজয়ের পর ভারতীয় ড্রেসিংরুমে আমন্ত্রণ…
তখন একটা ক্যাম্পেন চলছিল– শচীন কা সপনা, ওয়ার্ল্ড কাপ হ্যায় আপনা। শচীন স্যর তার আগে ছ’টা বিশ্বকাপ খেলেছিলেন। কিন্তু জিততে পারেননি। তাই স্পনসররা একটা ক্যাম্পেন শুরু করেছিল বিশেষভাবে। যেহেতু ওটা শচীন স্যরের শেষ বিশ্বকাপ ছিল।
আর শেষে ২০১১ সালের ২ এপ্রিল আমরা বিশ্বকাপ জিতলাম যখন, নিরাপত্তারক্ষীরা গ্যালারিতে আমার কাছে চলে এসেছিল। আমি ভাবছিলাম, আবার কী ভুল করলাম আমি? নিরাপত্তারক্ষীরা আমাকে ড্রেসিংরুমের সামনে নিয়ে গেল। দেখলাম, শচীন স্যর আমাকে ড্রেসিংরুমের সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে বলছেন। আমি প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি। শচীন স্যর আমাকে ডাকছেন! মনে আছে, তিনটে করে সিঁড়ির ধাপ একসঙ্গে টপকে ড্রেসিংরুমে পৌঁছেছিলাম আমি। সেই মুহূর্ত বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমাকে খেলার আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে শরীরে রং করতে হয়, কারণ সেটা শুকোতে সময় লাগে। কখনও কখনও খাওয়াদাওয়াও করতে পারি না আমি। আমি যে জাতীয় পতাকা নাগাড়ে দোলাই কিংবা শাঁখ বাজাই, পুরোটাই শচীন স্যরের প্রতি আবেগে, ভালবাসায়। জাহির ভাই (জাহির খান) আমাকে সে দিন বলেছিলেন, বিশ্বকাপ ট্রফিটা তুলতে! শচীন স্যর এসে বিশ্বকাপকে সামনে রেখে আমার সঙ্গে ছবি তুলেছিলেন! সেটা সম্ভব হয়েছিল, একমাত্র শচীন স্যরের জন্য।
আরও শুনুন:Sachin@50: বেন অ্যাফ্লেক, রবার্ট প্যাটিনসন নন, আমার দেখা সেরা ‘ব্যাটম্যান’ শচীন
রোড সেফটি সিরিজে মাস্টারের জন্য্য গলা ফাটানো…
ন’বছর হয়ে গেল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে নিয়েছেন শচীন স্যর। কিন্তু আমার হৃদয় থেকে তিনি অবসর নেননি। কোনও দিন নেবেনও না। সুধীর গৌতমকে লোকে চেনে শচীনের সমর্থক হিসাবে, ভক্ত হিসাবে। সেটাই আমার একমাত্র পরিচয়। আর উনি অবসর নিতে পারেনই বা কীভাবে? উনি যখন রোড সেফটি সিরিজ খেলেন, আমি গিয়ে উৎসাহ দিই ওঁকে। ওঁর জন্য গলা ফাটাই। উনি দু’বার জিতেছেন সিরিজটা। আর দু’বারই আমি মাঠে ছিলাম। উনি আমাকে ট্রফিটা ধরতে দিয়েছেন, আমার সঙ্গে ছবি তুলেছেন। আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে উনি অবসর নেওয়ার পর, শরীরের লেখাটা পালটে ফেলেছি আমি। সেখানে এখন লেখা থাকে– মিস ইউ তেণ্ডুলকর।
খরচ করে বিদেশ নিয়ে যাওয়া…
অস্ট্রেলিয়ায় ২০১৫ বিশ্বকাপের আগে শচীন স্যরের সঙ্গে দেখা করে আমি বলেছিলাম যে, বিশ্বকাপে আমি ভারতীয় টিমের হয়ে গলা ফাটাতে চাই। উনি মুহূর্তের মধ্যে আমার ফ্লাইট টিকিট করিয়ে, ভিসা বানিয়ে, হোটেল বুকিং করে দিয়েছিলেন। এমনকী, এম্ব্যাসিতে উনি চিঠি লিখে দিয়েছিলেন নিজে, যাতে আমাকে কোনও সমস্যার মুখে না পড়তে হয়।
আরও শুনুন: Sachin@50: আমার লেগ গার্ড শচীনকে দিতে দ্বিধা করিনি
১৪ ফেব্রুয়ারি অ্যাডিলেড পৌঁছই আমি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের উদ্বোধনী ম্যাচের আগে। কিন্তু আমাকে প্র্যাকটিস এরিনায় যেতে দেওয়া হয়নি। সেটা নিয়ে আমি খুব ভেঙেও পড়েছিলাম। কিন্তু শচীন স্যর নিশ্চিত করেছিলেন যে, পরের ম্যাচের ট্রেনিং সেশনে আমি যাতে থাকতে পারি। আমি জীবনে যতবার বিদেশ গিয়েছি, প্রতিবার শচীন স্যর সব কিছুর বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। এমনকী, অস্ট্রেলিয়ায় ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময়ও সব কিছুর বন্দোবস্ত উনিই করে দেন।
শচীন স্যরের জন্মদিনে ওঁর বাড়ি যাওয়া…
শচীন স্যরের জন্মদিনে ওঁর বাড়ি যেতে পারলে আমার খুব ভাল লাগে। উনি নিজের ভক্তদের সঙ্গে কেক কাটেন। আমাদের দিনটাও এক লহমায় দারুণ হয়ে যায়। আমি কখনও ছবি, কখনও গণেশ মূর্তি, কখনও বা রমাকান্ত আচরেকর স্যরের ছবি নিয়ে যাই শচীন স্যরের জন্মদিনে। গত দু’বছর উনি ভক্তদের সঙ্গে জন্মদিন কাটাননি কোভিডের কারণে। কিন্তু এবার ওঁর বাড়ি যেতে চাই। বেশিরভাগ সময়ই শচীন স্যরের জন্মদিনে ওয়াংখেড়েতে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের ম্যাচ পড়ে। উনি কিন্তু আমাকে সেই খেলার টিকিট দিতে ভোলেন না।
পঞ্চাশতম জন্মদিনে মাস্টারকে শুভেচ্ছা…
আমার কাছে শচীন তেণ্ডুলকর ঈশ্বর। আমি ওঁকে হৃদয় থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে চাই। শচীন স্যরের সমস্ত সমর্থকদের পক্ষ থেকে ওঁকে আগামীর যাবতীয় শুভেচ্ছা।