ঠাকুর মা সারদা হলেন স্বয়ং সরস্বতী বলতেন। গোটা সমাজে এসেছেন, সকলকে জ্ঞান বিতরণ করতে। মা সারদাকে দেবী সরস্বতী রুপে জগৎবাসীর কাছে চিনিয়ে দিয়েছিলেন স্বয়ং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। আসুন শুনে নেওয়া যাক।
‘ও সারদা- সরস্বতী- জ্ঞান দিতে এসেছে’- শ্রীমা সারদাকে এভাবেই জগৎবাসীর কাছে চিনিয়ে দিয়েছিলেন স্বয়ং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। ঠাকুরের এই সংক্ষিপ্ত কথাটিতেই যেন দেবী সরস্বতীর রূপ, বিবর্তন এবং নানা রূপে প্রকাশ একীভূত হয়ে আছে। দেবী সরস্বতী বিদ্যা ও জ্ঞানের দেবী। তিনি আমাদের মেধা দেন। যে মেধা উর্বর করে এই সভ্যতাকে। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই যেন তাই মিশে আছে সরস্বতী-প্রবাহ। ঠাকুর যেন সেদিন জানিয়ে দিয়েছিলেন, আধুনিক সভ্যতার যে রথ চলতে শুরু করেছে, সেখানে শ্রীমার জ্ঞান মিশে থাকবে সেই আবহমান প্রবাহ হয়েই।
:আরও শুনুন:
কুল না খেলেই তুষ্ট হন দেবী! সরস্বতী পুজোয় আর কোন নিয়ম না মানলেই নয়?
সরস্বতী একাধারে নদী এবং দেবী। বেদে তাঁর পরিচয় নদী হিসাবেই। একদা জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র ছিল এই সরস্বতী নদীর সংলগ্ন অঞ্চলই। তাই তাঁর স্তবে বলা হয়- নদীতমে, দেবীতমে, অম্বিতমে। জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সরস্বতীর যে যোগ, তা যেন এই স্তবে খুব স্পষ্ট করেই প্রকাশ পেয়েছে। নদী সভ্যতাকে লালন করে। সেই লালনের নানা মাত্রা আছে। নদী যেমন একদিক থেকে আমাদের অন্ন জোগায়, আবার আমাদের মেধারও বিকাশ ঘটায়। জ্ঞান তো সীমিত হয়ে থাকে না। জ্ঞান প্রবাহিণী। নদীপথেই তা প্রবাহিত হয়েছে এক কালে। সরস্বতী নদীর অববাহিকা জুড়ে এই যে জ্ঞানচর্চার বিস্তৃত পরিসর, তা সরস্বতীকে একদিকে নদী ও অন্যদিকে মাতৃরূপে প্রতিষ্ঠা করেছে। ব্রাহ্মণসাহিত্যে সরস্বতী ও বাক্ তাই অভিন্না হয়েছেন। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতীর প্রসঙ্গ এসেছে। সেখানে তিনি সত্ত্বগুণময়ী। অর্থাৎ মহাশক্তিরই অন্য রূপ। আবার স্বতন্ত্র ভাবে তিনি বিদ্যার দেবী হিসাবে পূজিতা। সরস্বতীর এই যে বিবর্তন, তা যেন এক কথায় প্রকাশ করে দিয়েছেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। রামকৃষ্ণ ভাবধারার যে অনন্ত স্রোত, তা সদর্থেই লালন করেছেন শ্রীমা। সংঘ স্থাপনার মূল সূত্র তিনিই। যে সংঘের সূত্রে আধুনিক জ্ঞানচর্চার দিগন্ত খুলে যাবে ভবিষ্যতে, তার গোড়াপত্তন হয়েছিল শ্রীমার ভাবনাতেই। সেকালের বহু সংস্কার অতিক্রম করে, যে উদার, আধুনিক ও সময়পোযোগী কর্মযোগের মন্ত্র তিনি জগৎকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন, তার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। নদী সরস্বতী, বাক্ সরস্বতী যেমন জগৎকে জ্ঞানের আলো দেখিয়েছিলেন, শ্রীমা সারদাও তেমনই নতুন আলোর দিশা দিলেন।
:আরও শুনুন:
হাঁসের বদলে সরস্বতীর বাহন জোড়া বাঘ, পুজোর পর সিন্নি চড়ে মাজারেও, কোথায় জানেন?
সরস্বতীর ধারা অধুনা লুপ্ত হয়েছে। তবে জ্ঞানের যে প্রবাহ একদা তাঁর সূত্রে পেয়েছিল সভ্যতা, তা হয়ে উঠেছে চালিকাশক্তি। আর তাই সরস্বতী নদীতমা, দেবীতমা হয়ে আজও পূজিতা। যুগে যুগে যেন তাঁর পুনরাভির্ভাব। এই সভ্যতাকে নতুন চালিকাশক্তি, নতুন মন্ত্র শিখিয়ে দেওয়ার জন্য। আর তাই এসেছিলেন শ্রীমা। সরস্বতী আরাধনায় তাই আমরা স্মরণ রাখি ঠাকুরের সেই দিব্য বাণী- ‘ও সারদা- সরস্বতী- জ্ঞান দিতে এসেছে’। তিনি সারদা, তিনিই সরস্বতী। এসেছেন জ্ঞান বিলিয়ে দিতে। শ্রীমার প্রজ্ঞার আলোই তাই যেন অন্ধকার থেকে উত্তরণে আমাদের আশ্রয়, সহায়।