১৯৮৩ সালের ২৫ জুন। বিশ্বমঞ্চে ভারতীয় ক্রিকেটের জয়যাত্রার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেদিনই। তারপর কেটে গিয়েছে চারটে দশক। সময় বদলে গিয়েছে, পালটে গিয়েছে দেশের মন আর মানুষ। তবু আজও যেন দেশবাসী বুকের গভীরে কান পেতে শুনতে পায় শত ঝরনার জলোচ্ছ্বাস। ২৫ জুন আধুনিক পৃথিবীতে নতুন ভারতবর্ষের মাথা তুলে দাঁড়ানোর দিন। সেদিনের বিশ্বজয় কীভাবে বদলে দিয়েছিল দেশের ক্রিকেট-মানচিত্র? ফিরে দেখলেন রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়।
ওই ধোঁয়া-ধোঁয়া, সাদা-কালো অবয়বের দল না থাকলে বিরাট কোহলির সাত লক্ষের নতুন হাতঘড়ির দামের শূন্য-সংখ্যা একটা কমত নিশ্চিত। কোনও এক মহেন্দ্র সিং ধোনিও ভারত জার্সি চিরতরে তুলে রাখার বছর আড়াই পরে পৃথিবীর ধনকুবের ক্রিকেটারদের একজন হয়ে থেকে যেতেন না!
ওই ধোঁয়া-ধোঁয়া, সাদা-কালো ছবির অবয়ব-দল ভারতের ক্রিকেট-পূর্বপুরুষ। উত্তমপুরুষও বটে। যাঁরা অধুনা ভারতীয় ক্রিকেটের তেজিয়ান রংবাহার দেখেননি, বছর চল্লিশ আগে যাঁরা ভাবতে পারেনি তাঁদেরই দেশের এক ঘরোয়া টুর্নামেন্টের (আইপিএল তাই-ই) সম্প্রচারসত্ত্ব পলকে বিক্রি হয়ে যাবে অলীক পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকায়! ভাবতে পারেননি, ভাবার মতো পরিস্থিতিও যে ছিল না বিশেষ। পুরাতন ভারতীয় ক্রিকেট যে বড় অনটনের ছিল। যেখানে ক্লাইভের ক্যারিবিয়ানদের হারিয়ে ভুবনজয়ের পরেও পুরস্কার-প্রদানে হাজার দশেক জোটাতে গলদঘর্ম হতে হয়েছিল বোর্ডকে। লতা মঙ্গেশকরের কনসার্টের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল শেষে, অসম্মানের শাপমোচনে।
আরও শুনুন: ঐতিহাসিক ২৫ জুন! বিশ্বজয়ের শ্যাম্পেন সেদিন কার থেকে নিয়েছিলেন কপিল দেব?
আমরা, আটের দশকের জাতক যারা, আমাদের কাছে ওই ধোঁয়া-ধোঁয়া, সাদা-কালো অবয়বের নাম কখনও কপিল, কখনও সুনীল। কখনও মহিন্দর, কখনও বলবিন্দর। কী করা যাবে, সেই সময় শিরা-উপশিরায় যাঁকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে বেড়ে উঠেছিল আমাদের শৈশব-কৈশোর, তাঁর নাম শচীন তেণ্ডুলকর। যাঁর রাক্ষুসে ব্যাটিং ফালাফালা করে দিত বিপক্ষকে, বিশ্বের ক্রিকেট-মন্দিরে একটু একটু করে স্থায়িত্ব দিত ভারতবর্ষ নামক বিগ্রহকে। কপিল-সুনীলদের কীর্তি আমাদের জন্ম পূর্ববর্তী, তাঁরা থাকতেন খেলার বইয়ে, রঙিন ছবিতে, কালো কালিতে। যাঁদের ক্রিকেট চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য ঘটেনি কখনও, আসেনি তাঁদের মহিমা অনুধাবনের সুযোগ। কিন্তু অশরীরী একটা অস্তিত্ব টের পাওয়া যেত ঠিক, সময়-অসময়ে, যেন ওঁরা আছেন সব, আছেন আশেপাশে। সবাই সব দেখছেন, খেয়াল করছেন, ভুলভ্রান্তি দেখলে শুধরে দিচ্ছেন অলক্ষ্যে, স্নেহশীল পিতার মতো।
সে দিক থেকে দেখতে গেলে কপিল দেবদের ঐতিহাসিক ২৫ জুনের চল্লিশ বছর পূর্তি নিয়ে লিখতে বসা, ছোকরা সাংবাদিকের অপার ধৃষ্টতা বিশেষ। টিম পিছু সাতাত্তর সাপোর্ট স্টাফের সময়ে বসে কী করে বুঝব সেই ভারতকে, বিশ্বকাপের মতো মহামঞ্চে যার কোচ পর্যন্ত ছিল না? বেপরোয়া বিরাট কোহলিদের হাঁকডাক এড়িয়ে কী করে বুঝব সেই ভারতকে, যার অধিনায়কের মুখে বিশ্বজয়ের আহ্বান শুনে অবিশ্বাসী হাসি হাসে তারই টিম সতীর্থ? বিশ্বকাপকে ‘স্টপওভার টুর্নামেন্ট’ হিসেবে দেখে যারা আগাম টিকিট কেটে রাখে ছুটি কাটানোর, দ্রুতই টুর্নামেন্টের পাট চুকে যাবে সেই গভীর বিশ্বাসে! নাহ্, সেই সময় যাঁরা জন্মাননি, বোঝা তাঁদের পক্ষে সম্ভবই নয়। বরং শ্রদ্ধার ফুলে ঢেকে দেওয়া যায় সেই এগারোর পদতল, যাঁরা ২৫ জুন, ১৯৮৩-তে এক নতুন, বিত্তশালী ভারতীয় ক্রিকেটের শিলালিপি স্থাপন করে দিয়েছিলেন!
এটা অনস্বীকার্য যে, ক্রিকেটে ভারত আজ যে জায়গায়, তার নেপথ্য কারণ চল্লিশ বছর আগে কপিলদের বিশ্বজয়। কারণ–তিরাশির ইতিহাসের পরই সাতাশিতে দেশে বিশ্বকাপ আয়োজন করার সুযোগ পায় ভারত। ভারতীয় বোর্ডেরও যার পর থেকে স্বাবলম্বী হওয়া শুরু। শুরু বিশ্বক্রিকেটের প্রভাব-ক্ষমতার অলিগলিতে প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়ার হাত ধরে ঢুকে পড়া। দেশের খেলা দেখাতে এক সময় দূরদর্শনকে অর্থ দিতে হত বোর্ডকে। আর আজ কোহলি-রোহিতদের খেলা দেখাতে ভারতীয় বোর্ডকে কোটি কোটি টাকা দিতে হয় সম্প্রচারকারী সংস্থাকে। পরবর্তী ক্রিকেট প্রজন্মও লাভবান হয়েছে কত। তিরাশির লোকগাথা তাঁদের জীবনে আদতে এক দমকা হাওয়া, যা এক ধাক্কায় খুলে দিয়েছিল বিজ্ঞাপনী দুনিয়ার অর্গল। নয়ের দশকে ওয়ার্ল্ডটেলের সঙ্গে শচীনের চুক্তির অঙ্ক দেখে চোখ কপালে ওঠেনি? সৌরভ-দ্রাবিড়দের সই করাতে মুহুর্মুহু ঝাঁপিয়ে পড়েনি বহুজাতিকরা? বিশ্বাস করুন বা না করুন, মানুন কিংবা না মানুন, এ সমস্ত পুরোটাই হয়েছিল ভারত আবার বিশ্বজয়ী হবে সেই অভিলাষে। কারণ–ভারতও যে পারে বিশ্বকাপ জিততে, তা ততদিনে প্রমাণিত। সৌজন্যে–কপিল’স ডেভিলস। স্থান– ২৫ জুনের লর্ডস। আসলে শুধু কালজয়ী প্রতিভা দিয়ে চলে না। শুধু প্রতিভায় অর্থ ছুটে আসে না। কর্পোরেটকে টানতে গেলে প্রতিভার সঙ্গে সাফল্যের মায়া-বিচ্ছুরণও লাগে।
আরও শুনুন: ১৯৮৩ সালের ২৫ জুন ভারতের ক্রিকেট জেগে উঠেছিল এক নতুন দিনের ভোরে
শোনা যাচ্ছে, তিরাশির চল্লিশ বছর পূর্তির উৎসব হবে মুম্বইয়ে। পুরো টিমটা থাকবে। সময়-সময় মনে হচ্ছে, রজার বিনির ভারতীয় বোর্ডেরও তো সেই অনুষ্ঠানের সঙ্গে ওতঃপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়া উচিত। বোর্ড প্রেসিডেন্ট রজার সেই বিশ্বজয়ী টিমের সদস্য শুধু ছিলেন না, বোর্ড প্রশাসনে থেকে তিনিও নিশ্চিত ভাবে এটা জানেন যে, বর্তমান ভারতীয় বোর্ডের এই রমরমার নেপথ্যেও ঘুরেফিরে সেই তিরাশি। আইসিসির লভ্যাংশের বড় অংশ দখলে পেশিশক্তি ভারত দেখাতে পারত তো, তিরাশির অবিস্মরণীয় বিশ্বজয় না থাকলে? দেশজুড়ে বাবা-মায়েরা নেশাগ্রস্তের মতো সন্তানকে নিয়ে শচীন-সৌরভ-ধোনি করার আকাঙ্খায় ছুটতেন তো কোচিং ক্যাম্পে, তিরাশির নামক আস্থার পাদানি না থাকলে? ‘ব্র্যান্ড ইন্ডিয়া’ কিন্তু এই আবেগের মালা গেঁথে হয়েছে, যেখানে ক্রিকেটের সমনামী হয়েছে ধর্ম। মনে রাখতে হবে, ধোনি যুগে দু-দু’টো বিশ্বকাপ জয় ঘটেছিল বটে, তবে সেটা ২০০৭ সাল থেকে। তত দিনে ভারতীয় বোর্ড কিন্তু ক্রিকেট-সভায় শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট আসন নিয়ে ফেলেছে, প্রপাতের মতো দেশে উঠে আসছে প্রতিভা, যাঁদের হাত ধরে দ্বিতীয় বিশ্বজয় স্রেফ সময়ের অপেক্ষা ছিল।
আর তাই, চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট-একশো-অর্বুদ, যত বছরই আগামীতে প্রবাহিত হোক, তিরাশির অবস্থান আসমুদ্রহিমাচলে অক্ষয় সূর্য-র মতোই থেকে যাবে। থেকে যাবে ততদিন, ভারতবর্ষে ক্রিকেট থাকবে যতদিন। আর বছর ঘুরে দিনটা আসবে যত বার, স্মৃতির অ্যালবামের ধুলো ঝেড়ে নতুন ভাবে আত্মপ্রকাশ করবে ওই অবয়ব-দল, প্রতিবার।
যাঁরা ছায়া-ছায়া, ধোঁয়া-ধোঁয়া, সাদা-কালো। যাঁদের হাত ধরে রঙিন ভারত টলমল পায়ে হাঁটতে শিখেছিল!